“যেমন- বাংলা ভাষার ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটা মারমা ভাষায় কী হবে, তা নিয়ে এখনও আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।”
Published : 20 Feb 2024, 11:32 PM
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবার বাংলাদেশে বসবাসরত ছয়টি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
ভাষা ও ব্যাকরণগত নানা সমস্যা আর সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে চাকমা, মারমা, ককবরক, গারো, কুড়মালি ও সাদরি- ভাষায় বইটি অনুবাদ করেছেন সেই নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাই। যাদের মধ্যে অনেকে মাতৃভাষা শেখার পর এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কাজ করেছেন।
এর মধ্যে মারমা ভাষায় অনুবাদ করেছেন নুথোয়াই মারমা, গারোদের আচিক ভাষায় বাঁধন আরেং, সাদরি ভাষায় যোগেন্দ্র নাথ, ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষায় মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, চাকমা ভাষায় আর্যমিত্র চাকমা এবং মাহাতোদের কুড়মালি ভাষায় উজ্জ্বল মাহাতো।
এসব বই প্রকাশে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট।
এ ঘটনাকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক অধ্যাপক হাকিম আরিফ বলেন, বুধবার একুশে ফেব্রুয়ারির বিকালে ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় অনূদিত বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এ উদ্যোগের ফলে চাকমা, মারমা, ককবরক, গারো, কুড়মালি ও সাদরি ভাষার শব্দের সংখ্যাও বেড়ে গেল এবং ভাষার প্রকাশ ক্ষমতাও বেড়ে গেল। সংশ্লিষ্ট ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার যেমন মিথষ্ক্রিয়া তৈরি হবে, তেমনি বাঙালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মানসিক ঐক্যবন্ধনও দৃঢ় হবে।”
অনুবাদক নুথোয়াই মারমা ও মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। অনুবাদের কাজ করতে গিয়ে যে ভাষাগত সমস্যায় পড়েছেন সেটি তুলে ধরেছেন তারা।
পাশাপাশি বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের মাতৃভাষাকে পৌঁছে দিতে সরকারি উদ্যোগের আহ্বানও জানিয়েছেন।
‘অনেকটা পিছিয়ে আছি’
নুথোয়াই মারমার জন্ম ও বেড়ে উঠা বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার অংজাইপাড়ায়। স্থানীয়ভাবে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন।
সেখান থেকেই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এখন লেখালেখির পাশাপাশি নিজের সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে ভাষা চর্চার জন্য কাজ করছেন। তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের অনুবাদ ছাড়াও নিজের মাতৃভাষায় মারমা জাতির ইতিহাস বিষয়ে একটি বই লিখেছেন।
অনুবাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কেন বেছে নিলেন?
নুথোয়াই মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় বইটি পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুদিত হয়। তখন থেকেই নিজের ভাষায় সেটি অনুবাদ করার তাড়না আসে তার মধ্যে।
“এরপর কাজটা নিয়ে বসি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ মিলিয়ে অর্ধেক করে রাখি। মাঝখানে পড়াশোনা ও পরীক্ষার চাপ বেড়ে যায়। এ কারণে অনুবাদের কাজে ছেদ পড়ে।”
এর মধ্যে একদিন মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মারমা ভাষায় অনুবাদ করার জন্য নুথোয়াইকে ডাকে। তখন তিনি ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালককে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অনুবাদ শুরু করার কথা জানান। এবং এ কাজে ইন্সটিটিউটের সহায়তার জন্য একটি প্রস্তাব দেন।
সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট মারমাসহ ছয়টি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগ নেয়। এবং সবাইকে এক লাখ টাকা দেওয়া হয় বইটি নিয়ে কাজ করতে।
তবে বাংলা থেকে মারমা ভাষায় বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে ভাষাগত নানা সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কথা জানালেন নুথোয়াই মারমা।
তিনি বলেন, মারমা ভাষার নিজস্ব কোনো অভিধান নেই। এ কারণে অনেকক্ষেত্রে বাংলা শব্দগুলোর মারমা অর্থ তার মনে আসছিল না। তবে সম্প্রদায়ের প্রবীণ সদস্য আর গবেষকদের সহায়তায় তিনি এসব সমস্যা উৎরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
নুথোয়াই বলেন, “যেমন- বাংলা ভাষার ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটা মারমা ভাষায় কী হবে, তা নিয়ে এখনও আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।”
নিজের ভাষার বইটিকে সব বয়সের মারমাদের কাছে পৌঁছাতে নানা সীমাবদ্ধতার কথাও বললেন নুথোয়াই।
“মারমা ভাষা জানার মানুষ একেবারেই হাতেগোনা। আমি গত বছর একটা বই লিখেছি মারমাদের নিয়ে। সেটা ১০ জনের বেশি পড়তে পারেননি। এ থেকে বুঝতে পারলাম ভাষাগত দিক দিয়ে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি।”
“রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে তখন হয়ত আরও অনেকেই এগিয়ে যাবে। নিজেদের উদ্যোগে অনেকে ভাষা শিক্ষাটা চালু রেখেছে”, বলেন নুথোয়াই মারমা।
অনেক রাজনৈতিক পরিভাষা ককবরকে নেই
মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার জন্ম ও বেড়ে উঠা খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গার গোমতি এলাকায়। দেশের নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার চিত্র, মাতৃভাষায় শিক্ষা পরিস্থিতি, মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষার মত বিষয়ে গবেষণায় ভূমিকার জন্য ২০২১ সালে সরকার তাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকে ভূষিত করে।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা অনুবাদ করেছেন রোমান হরফে। ককবরক ভাষা বর্তমানে রোমান হরফে লেখা হয়।
তিনি তার ছেলেবেলার কথা স্মরণ করে বলেন, সেই পরিবেশ ককবরক ভাষাময় ছিল। সেখানে অন্য কোনো ভাষার সংস্পর্শ ছিল না।
দীর্ঘদিন তিনি ককবরক ভাষার জার্নাল ‘সান্তুয়া’তে লেখালেখির চর্চা চালিয়েছেন। ফলে ভাষাটি শেখা তার জন্য সহজ ছিল।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট থেকে প্রস্তাব পেয়ে মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা ২০২২ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অনুবাদের কাজ শুরু করেন। তবে অনুবাদ করতে গিয়ে তাকেও ভাষাগত নানা সীমাবদ্ধতায় পড়তে হয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যেসব রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, ওই সময়ের যে প্রেক্ষাপট সেটার বাংলা যে শব্দগুলো- অনেক শব্দ তো আমার মাতৃভাষায় নেই।
“সেক্ষেত্রে আমাকে নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। পুরনো অনেক অভিধান দেখতে হয়েছে। এমন যদি কোনো শব্দ হয় যে, যেটা রাখতেই হবে সেগুলোকে আর পরিবর্তন করিনি। বাংলাতেই রেখে দিয়েছি।”
বইটি অনুবাদ শেষে ত্রিপুরা জনজাতির নতুন প্রজন্মের অনেককে দিয়ে পড়িয়েছেন। তারপর তারা যেভাবে মাতৃভাষায় বোঝেন সেভাবে লিখতে দেন। নতুন প্রজন্মের কিছু লিখিত রূপ তিনি নিজের মত পরে সম্পাদনা করেছেন।
মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ককবরক ভাষী নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই আর মাতৃভাষার চর্চা করছেন না। তবে কেউ কেউ তাতে গুরুত্বও দিচ্ছে। ছোট ছোট পত্রিকাও প্রকাশ করছেন তারা।
“তারা যদি না বলে, চর্চা না করে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত পরে আর এটা ব্যবহার করবে না। মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করা, ব্যবহার করা, পরিচর্যা করা সব প্রজন্মের দায়িত্ব।”