স্থানীয়ভাবে একটি এবং ঢাকা থেকে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে।
Published : 26 Mar 2024, 09:41 PM
বারো বছরের কিশোরী সেনিয়া আক্তার এখনও জানে না তার পরিবারের সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আর কোনোদিন নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে তার দেখা হবে না।
মঙ্গলবার ভোরে পল্লী বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে সোনিয়ার পরিবারের সবাই নিহত হয়েছে। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হয় সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সেখানে দিনভর আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিল। রাতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সন্ধ্যায় হাসপাতালে আইসিইউয়ের সামনে অনেকটা ভাবলেশহীন দাঁড়িয়েছিলেন সোনিয়ার মামা আজির উদ্দিন; তার চোখ টলমল করছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলছিলেন, “তুফানের সময় লাই ছিঁড়ে পড়েছিল মনে হয়, আর সাড়ে পাঁচটার দিকে কারেন্ট আসলে তারা সবাই মারা যান। আমরা প্রথমে ছয়জনকে মৃত মনে করে লাশ সারি করে রাখি।
“আমাদের সঙ্গের একজন দেখেন সোনিয়ার শরীর লড়ে। তারপর নিয়ে হাসপাতালে আসার পর পাঁচ তলায় ভর্তি করাই। দুপুর ১টার দিকে আইসিইউতে আনা হইছে”, বলেন তিনি।
আজির উদ্দিনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখনও জ্ঞান ফেরেনি সোনিয়ার।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভোরে সেহরি খাওয়ার পর যখন সবাই বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব গোয়ালবাড়ী গ্রামের ভাঙ্গার পাড় এলাকায় সোনিয়াদের ঘরের উপর দিয়ে যাওয়া পল্লী বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে যায়।
তাতে ওই পরিবারের পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে এলাকাবাসী এসে আগুন নেভায় এবং তাদের মরদেহ উদ্ধার করে।
আরও পড়ুন:
ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না দরিদ্র ফয়জুরের, সেই বিদ্যুতেই প্রাণ গেল পাঁচজনের
বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে টিনের চালে, এক পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ধারণা, বজ্রপাতে বৈদ্যুতিক খুঁটির ইনসুলেটর ক্র্যাক হয়ে যায় এবং এ সময় আগুন ধরে গিয়ে তার ছিঁড়ে ঘরের চালে পড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় নিহতরা হলেন- সোনিয়ার বাবা ফয়জুর রহমান (৫০), তার স্ত্রী শিরি বেগম (৪৫), তাদের মেয়ে সামিয়া (১৫), সাবিনা (৯) এবং ছেলে সায়েম উদ্দিন (৭)।
একমাত্র সোনিয়াকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, “মেয়েটির দেহের ২৫ ভাগ পুড়ে গেছে। তাকে আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। সাধারণত এ ধরনের রোগীদের হৃদরোগের সমস্যা দেখা দেয়। সোনিয়ারও সেই সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাই তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।”
রাত সাড়ে ৯টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে সোনিয়াকে ঢাকায় পাঠানো হয় বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবেশীরা জানান, ফয়জুর ছিলেন বাক-প্রতিবন্ধী, দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। নিজের কোনো জায়গা-জমি না থাকায় তিনি অন্যের জমিতে ঘর করে বসবাস করতেন। দরিদ্র ফয়জুর নিজের ঘরে কোনো বিদ্যুৎ নিতে পারেননি। তিনি সোলার প্যানেল ব্যবহার করতেন।
ফয়জুরের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ তার শ্বশুরবাড়ির। আজির উদ্দিন বলছিলেন, ভোরে তারা তাদের বাড়ি থেকেই বোনের বাড়ির চালে আগুন দেখতে পান।
তিনি বলছিলেন, “আমরা আগুন দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখি পুরো বাড়িতে আগুন জ্বলছে। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি লাশ পড়ে আছে ঘরের ভেতরে। পরে মসজিদ থেকে মানুষজন আসে। আমরা তখন লাশগুলো বের করি। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আসে।”
আরও পড়ুন:
বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পাঁচজনের মৃত্যুর তদন্তে ২ কমিটি
হাসপাতালের বারান্দায় বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন আজির উদ্দিনের আরেক ভাই ফাহিম উদ্দিন। তিনি বাকরুদ্ধ। এরই মধ্যে চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছে, সোনিয়াকে নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে। তার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন তারা। পল্লী বিদ্যুতের লোকজন খোঁজ-খবর নিচ্ছে বলেও জানালেন।
ফাহিম উদ্দিন বলেন, “মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন ভাই। তার তো আর কেউ নাই।”
তিনি জানান, বিকাল ৪টায় নিহত পাঁচজনকে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
ফাহিম আক্ষেপ করে বলছিলেন, “আমার বোনের ঘরে কারেন্ট ছিল না, তারা সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতেন। অথচ কারেন্টের কারণেই সবাই মরল।”
মামলার ব্যাপারে জানতে চাইল ফাহিম বলেন, “আমরা আগে রোগীকে বাঁচাই; তারপর মামলার বিষয়ে চিন্তা করব। বিদ্যুতের লোকজনও আমাদের সঙ্গে আছেন।”
আজির উদ্দিন আর ফাহিম উদ্দিনের সঙ্গে হাসপাতালে এসেছেন তাদের আপন চাচাত ভাই শামীম উদ্দিন।
তিনি বলছিলেন, “আমরা সেনিয়াকে নিয়ে আসার সময় দেখেছি বাড়িতে আগুন জ্বলছে। প্রথমে আমরা উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা বলল, ওসমানীতে নিয়ে আসার জন্য। তারপর আমরা আর দেরি করিনি।”
এদিকে জুড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, এ ঘটনায় জীবিত একমাত্র শিশুটির পাশে প্রশাসন রয়েছে।
এদিকে ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলে ছুটে যান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা।
এ সময় মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ বি এম মিজানুর রহমান বলেন, বিদ্যুতের তারের নিচে ঘর না বানানোর নির্দেশ রয়েছে।
ঘটনাটি তদন্তে এরই মধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।