Published : 03 May 2025, 10:22 PM
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় ‘ব্যক্তিগত আয়নাঘর’ থেকে ছয় মাস পর মুক্ত নারী জানিয়েছেন, তাকে অধিকাংশ সময়ই অজ্ঞান করে রাখা হত; জ্ঞান ফিরলেই দেওয়া হত চেতনানাশক ইনজেকশন। বিভিন্ন সময় নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি খুব অল্প পরিমাণের খাবার সরবরাহ করা হত।
ওই নারীর সঙ্গে মুক্ত হওয়া আরেক পুরুষ সদস্যও একই অভিযোগ করে বলেছেন, মূলত জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরেই প্রতিপক্ষের লোকজন তাদের তুলে নিয়ে ‘আয়নাঘরে’ বন্দি করে রাখে।
বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সোনারাম গ্রামে জহুরুল ইসলামের ছেলে সুমন সেখের পাকা ভবনের ‘আয়নাঘর’ থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বেরিয়ে আসেন দুই নারী-পুরুষ; যাদেরকে ছয় মাস আগে তুলে নিয়ে সেখানে বন্দি করে রাখা হয়। শুক্রবার সকালে ঘটনাটি জানাজানি হলে লোকজন আয়নাঘর দেখতে ভিড় জমায়।
মুক্ত হওয়া ওই দুজন হচ্ছেন- উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের পূর্ব পাইকড়া গ্রামের প্রয়াত রুস্তম আলীর ছেলে আব্দুল জুব্বার (৭৫) এবং লক্ষ্মী বিষ্ণু প্রসাদ গ্রামের মনসুর আলীর স্ত্রী শিল্পী বেগম (৪৮)। বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে তারা মুক্ত হয়ে বাড়িতে ফেরেন।
পরে শিল্পী বেগমকে রায়গঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং আব্দুল জুব্বারকে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার পল্লী চিকিৎসক নাজমুল হোসেন আরাফাত উপজেলার পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামের রেজাউল করিম তালুকদারের ছেলে এবং ইনকিলাব পত্রিকার রায়গঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি। এ ঘটনার পর শুক্রবার তাকে রায়গঞ্জ প্রেস ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শনিবার সকালে এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর শিল্পী বেগমকে অপহরণ করা হয়েছিল। তারপর থেকে তিনি সেখানেই বন্দি ছিলেন।
শিল্পী বেগম বলছিলেন, ঘটনার দিন দুপুরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে পাশের খলিফাপাড়ার পান্না খাতুন তাকে ডেকে নিয়ে যায়। তবারীপাড়া এলাকায় গেলে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা একটি মাইক্রোবাসে তাকে জোর করে উঠানো হয়। এরপর স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে শরীরে ইনজেকশন দিলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
“এরপর থেকে জ্ঞান ফিরলেই আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হত। আরাফাতই আমার শরীরে ইনজেকশন দিত।”
শিল্পী বেগমকে যে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়; সেখানে আগে থেকেই বন্দি ছিলেন আব্দুল জুব্বার।
শিল্পী বেগম বলেন, “আমাদের দুইজনকে বাড়ির মালিক সুমন নিয়মিত খাবার দিতেন। সেখানে আরাফাত ও মোমিন নিয়মিত যাতায়াত করত। একদিন তাদের কাছে জানতে চাই, কবে মুক্তি পাব। তখন তারা বলে, তোর কিডনি বিক্রি করমু, এইটা আমাদের ব্যবসা।”
তিনি বলেন, “বন্দি অবস্থায় ঘরের পাশে একদিন ইসলামী জালসা হচ্ছিল। মাইকের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারি, আমরা নিজেদের এলাকাতেই আছি। এরপর বন্দিদশা থেকে পালানোর পরিকল্পনা করতে থাকি।
“এ অবস্থায় ওই ভবনের ভিতর দেওয়ালের পাশ থেকে মাটি সরাতে থাকি। চারদিন পর গভীর রাতে আমরা সেখান থেকে মুক্ত হই। এরপর হঠাৎপাড়া বাজারের গিয়ে একজনের সহায়তায় বাড়িতে সংবাদ দিলে স্বামী এসে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায়।”
আব্দুল জুব্বার অপহৃত হন ২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ঘটনার দিন ওষুধ কেনার জন্য হঠাৎবাজার এলাকায় গেলে পল্লী চিকিৎসক আরাফাত তাকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাকে সুমনদের বাড়িতে নিয়ে আটকে রাখা হয়।
“বাড়ির মালিক সুমন আমাদের মাঝে-মধ্যে অল্প খাবার দিতেন। সেখানে শিকল দিয়ে হাত বেঁধে রেখে মারধর করা হত। আরাফাতসহ অন্যরা কয়েক দিন পর পর এসে জমি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিত। কিন্তু আমি রাজি হইনি।”
২ মামলায় আসামি ২৫
শনিবার দুপুরে ভুক্তভোগী আব্দুল জুব্বারের ছেলে শফিকুল ইসলাম এবং শিল্পী বেগমের স্বামী মনসুর আলী খন্দকার দুটি মামলা করেছেন।
শফিকুল ইসলামের মামলায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও পাঁচ থেকে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। অপরদিকে মনসুর আলীর মামলায় ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারের বরাতে রায়গঞ্জ থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জায়গা-জমির বিরোধ থেকে এ দুজনকে অপহরণ করা হয়েছে।
আরাফাতকে দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিকালে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।
স্থানীয়রা জানান, ওই ভবনের সুমন সেখ। তার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ভবনের নিচের ফ্লোরে তিন-চারটি ছোট ছোট কক্ষ তৈরি করে পল্লী চিকিৎসক আরাফাত। তিনি ও তার কিছু লোকজন গভীর রাতে এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন।
শুক্রবার বিক্ষুব্ধ লোকজন সুমন ও আরাফাতের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এ বিষয়ে রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হুমায়ুন কবির বলেন, “ওই ভবনের ফ্লোরের নিচের অংশের সব কিছু আগের মতো রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীরা যেন ন্যায়বিচার পান, উপজেলা প্রশাসনের সেই বিষয়ে সার্বিক সহায়তা থাকবে।”
আরও পড়ুন
সিরাজগঞ্জে 'ব্যক্তিগত আয়নাঘর', সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বের হলেন নারী ও বৃদ্ধ