হামলায় আহত প্রত্যয়কে পরে জোর করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
Published : 07 Jun 2023, 12:22 PM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অছাত্রদের হল থেকে বের করাসহ তিন দফা দাবিতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীকে মারধর করে সরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে মীর মশাররফ হোসেন হলের মাঠে সাত দিন ধরে অবস্থানরত সামিউল ইসলাম প্রত্যয়ের ওপর এ হামলা হয়।
হামলায় আহত প্রত্যয়কে পরে জোর করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এই বিষয়ে বিশ্যবিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী প্রত্যয়ের ভাষ্য, “আমি মেডিকেলে আসতে চাইনি। আমাকে কয়েকজন মারধর করে, জোর করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেয়।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পূর্বনির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। সেই সুযোগে রাত ১১টার দিকে মীর মশাররফ হোসেন হল শাখা ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী হল থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর তারা অবস্থানরত শিক্ষার্থীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে তার বিছানা-বালিশে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে এনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীকে জোরপূর্বক অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
এ সময় বাধা দিতে গেলে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচীকে মারধর করা হয়। এছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আলিফ মাহমুদ, মাশিয়াত সৃষ্টি, মনিকা এবং শারমিন সুরকে হেনস্তা করা হয়।
মারধরের শিকার সৌমিক বাগচী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ইলেকট্রিসিটি না থাকার সুযোগ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা করা হয়েছে। এ সময় আমাদের সঙ্গে থাকা মেয়েদের শ্লীলতাহানি এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।"
সৌমিক বাগচী অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক গৌতম কুমার দাস (৪৫ ব্যাচ) হামলার ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সঙ্গে ছিলেন নোবেল (৪৩ ব্যাচ), রাব্বি (৪৫ ব্যাচ), মুরসালিন (৪৬ ব্যাচ), মুরাদ (৪৬ ব্যাচ), সোহেল (৪৬ ব্যাচ), তানভীর (৪৬ ব্যাচ), রায়হান (৪৬ ব্যাচ), রাহাত (৪৭ ব্যাচ), তুষায় (৪৫ ব্যাচ), ফেরদৌস (৪৫ ব্যাচ), তারেক মীর (৪৬ ব্যাচ), সজীব (৪৫ ব্যাচ) ও নাফিস (৪৬ ব্যাচ)সহ কয়েকজন।
এর আগে সন্ধ্যায় মীর মোশররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আলম এবং হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে অছাত্রদের তালিকা করতে যান। তার প্রেক্ষিতেই ছাত্রলীগের নেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্স চালক কামাল বলেন, “আমি মেডিকেলের ডাক্তারের মাধ্যমে জানতে পারি মীর মশাররফ হলে শিক্ষার্থী অসুস্থ। এ সময় আমি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সেখান থেকে অসুস্থ শিক্ষার্থীকে নিয়ে আসি। আসার পথে হলের শিক্ষার্থীরা অ্যাম্বুলেন্স ভাংচুর করে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে কর্তব্যরত চিকিৎসক আনিছুর রহমান বলেন, "রাতে মীর মশারফ হোসেন হল থেকে আমার কাছে একটি ফোন আসে। ফোনে জানানো হয় হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ। পরে আমি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাই। দুই জন শিক্ষার্থী সেই অ্যাম্বুলেন্সে আসে, এর মধ্যে প্রত্যয় নামে একজন ছিল।"
কে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স নিতে বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "গৌতম কুমার দাস নামে একজন ফোন করে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী।"
তবে ছাত্রলীগ নেতা গৌতম দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রত্যয়ের সাথে ঝামেলা করছিল তখন তাকে এবং তার সাথে অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছি।”
সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেখানে জুনিয়র শিক্ষার্থীই বেশি ছিল তবে সুনির্দিষ্টভাবে কারা ছিল বলতে পারব না।”
অ্যাম্বুলেন্স কেনো ডেকেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রত্যয় যদি কোনও সমস্যায় পড়ে সেজন্য একটা অ্যাম্বুলেন্স সবসময়ই থাকত। যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঝামেলা করছিল তখন ভাবলাম কোনও ঝামেলা হলে অ্যাম্বুলেন্স দরকার হতে পারে তাই ডেকেছিলাম।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “এখানে যেসব শিক্ষার্থী হামলা করেছে তাদেরকে আমরা শনাক্ত করতে পারি নি। তারা ছাত্রলীগ করে কি না এটাও জানি না। কারা হামলা করেছে আমরা তদন্ত করে বের করে ব্যবস্থা নেব।”
এদিকে সামিউল ইসলাম প্রত্যয়ের উপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে রাত ১২টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। তারা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের বাসভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন।
এ সময় পাঁচ দফা দাবি জানান শিক্ষার্থীরা৷
তাদের দাবিগুলো হলো- মীর মশাররফ হোসেন হলে অবস্থানরত সকল মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সূর্য উঠার আগে হল থেকে বিতাড়িত করতে হবে ও পর্যায়ক্রমে সকল হল থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছাড়া করতে হবে, ছাত্রী নিপীড়ন ও হামলাকারীর প্রত্যেককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে উপাচার্যকে বাদী হয়ে রাষ্ট্রীয় আইনে মামলা করতে হবে, প্রক্টর এবং প্রভোস্টকে অব্যাহতি দিতে হবে, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান করতে হবে, প্রথম বর্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সিটের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরে উপাচার্যের আশ্বাসে রাত ৩টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সরে আসেন।
জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পাঁচটি দাবি উপাচার্য মেনে নিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। বুধবার দুপুর ১টা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব তারা কি সিদ্ধান্ত নেয়। যদি দুপুরের মধ্যে কোনও সমাধান না আসে তাহলে আমরা আবার আন্দোলনে যাব।"
এদিকে প্রত্যয়কে সরিয়ে দেওয়ার পর তিনি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে অবস্থান করেন বলে জানায় তার সাথে সংহতি প্রকাশ করা শিক্ষার্থী আশফার রহমান নবীন।
আরও পড়ুন
জাবি ছাত্রের অবস্থান কর্মসূচির ৯৬ ঘণ্টা, শিক্ষকদের সংহতি
রাতে উপাচার্যের সাক্ষাৎ-আশ্বাস, তবুও অনড় জাবি শিক্ষার্থী