বান্দরবান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, জেলায় মোট ৬৮৬ মৎস্য চাষির ৫১০টি পুকুর ও ১৯০টি গোদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
Published : 18 Aug 2023, 06:52 PM
টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে পুকুর থেকে মাছ ভেসে গিয়ে বান্দরবান জেলায় প্রায় ৭০০ কৃষক ‘পথে বসে গেছেন’; তাদের চিন্তা এখন ব্যাংক ও এনজিওর ঋণ পরিশোধ নিয়ে।
কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন, বন্যার পানি কমার পর তারা পুকুরে জাল ফেলেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো মাছ আসেনি। বেশিরভাগ পুকুর ও গোদার (পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে তৈরি মাছ চাষ) পাড় বৃষ্টিতে ভেঙে গেছে। তাতে ভেসে গেছে মাছ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অভিজিৎ শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেলায় মোট ৬৮৬ জন মৎস্য চাষির ৫১০টি পুকুর ও ১৯০টি গোদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবকাঠামোসহ খামারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে মৎস্য চাষিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
“লামা উপজেলার মৎস্য চাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। লামাতে ২১০ জন মৎস্য চাষির ২৯৫টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ৬ লাখ টাকা।”
জেলায় ৬ অগাস্ট থেকে ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়ে হাজারো পরিবার। সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে গোটা জেলা কার্যত কয়েকদিন বিচ্ছিন্ন ছিল সারাদেশের সঙ্গে।
৯ অগাস্ট থেকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জনজীবন। এখনও জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে রুমা ও থানচি উপজেলার। তার মধ্যেই বেরিয়ে আসতে তাকে বন্যার ক্ষত।
বান্দরবান শহরের বালাঘটা এলাকার পুলপাড়ার বাসিন্দা আহম্মদ হোসেন চুক্তিভিত্তিক ইজারা নিয়ে পুকুর ও গোদায় মাছ চাষ করে আসছেন দীর্ঘদিন। ২০১৯ সালে বন্যায় কয়েকটি পুকুর ডুবে তার মূলধনই চলে গিয়েছিল। এ বছর আশায় বুক বেঁধেছিলেন ক্ষতি কাটিয়ে উঠার। কিন্তু বন্যা এবারও তার সেই আশা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
আহম্মদ হোসেন জানান, কয়েকজনের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া তার ১৬ কানির (৪০ শতকে ১ কানি) একটি গোদা, সাত কানির চারটি পুকুরে এখন আর কোনো মাছ নেই। মাছের খামারের জন্য একটি এনজিওর কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ঋণ আর কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছেন। এখন কিভাবে এই টাকা পরিশোধ করবেন সেই দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
এই মৎস্য চাষি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর পুকুরে মাছ আছে কিনা দেখতে জাল ফেলেছিলাম। কিন্তু পুকুরে কোনো মাছ পেলাম না। কয়েকবার জাল ফেলার পরেও মাছের দেখা পাইনি।”
রোয়াংছড়ি উপজেলার হানসামা এলাকায় আহম্মদ হোসেনের ১৬ কানির একটি গোদা আছে। সেই গোদাতে ৩০ মণের মত মাছ ছেড়েছিলেন। পাহাড়ি ঢল এসে পাড় ভেঙে সব মাছ ভেসে যায়।
তিনি বলছিলেন, “চৈত্র মাসে কেজিতে ৮-১০টি হয় এমন মাছ একটি গোদা ও চারটি পুকুরে ছেড়েছিলাম। প্রায় ৯০ মণ মাছ ছাড়ি। বাজার মূল্য হবে প্রায় ৮ লাখ টাকা। নাইলোটিকা, সরপুঁটি, রুই, কাতলা, পাঙ্গাস, কালিগনিয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
“২০১৯ সালের বন্যায় একবার ক্ষতি হয়েছিল। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এবারের বন্যায় আরও বেশি ক্ষতি করল আমাকে।”
বালাঘাটা এলাকার আরেক বাসিন্দা রসেন্দু তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “একসময় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতাম। সংস্থার প্রকল্প শেষ হওয়ায় পরে মাছ চাষে নেমে পড়ি। কয়েক বছর আগে পাশের বাকীছড়া এলাকায় নিজের ২ কানি জায়গার উপর দুটি পুকুরে কিছু পোনা ছেড়েছিলাম।
“মাছ বড় হওয়ার পর বিক্রি করে লাভও পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে লাভের আশায় আরও ৮০ হাজার টাকার পোনা মাছ ছাড়ি। কিন্তু সেই লাভের আশা ভেসে গেছে এবারের বন্যায়।”
বালাঘটার চড়ইপাড়ার বাসিন্দা মো. জামাল বলেন, “আমার পুকুর দুটি একটু উঁচু জায়গায় ছিল। ভেবেছিলাম বন্যার পানি এত উপরে উঠবে না। ভারি বৃষ্টির সময় গিয়ে দেখি চারদিকে বন্যার পানি থৈ থৈ করছে।
“পুকুরে মাছের কোনো চিহ্নই খুঁজে পেলাম না। সব মাছ ভেসে গেছে। এখন জাল ফেলে ছোট ছোট কিছু মাছ উঠে। খাওয়ার মত হয়। কিন্তু বিক্রি করার জন্য রাখা বড় বড় মাছ একটাও নেই, চলে গেছে।”
সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের চেমী ডলুপাড়ার বাসিন্দা উক্যসিং মারমা ও প্রুসানু মাস্টার জানান, তারা দুইজনে আলাদা জায়গাতে মাছ চাষ করেছিলেন। ভারি বৃষ্টির কারণে পুকুরের চারদিকে শক্ত করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে জালের বেড়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পুকুরের পাড় ভেঙে সব মাছ চলে গেছে।
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বান্দরবান সদর উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুনুর রহমান বলেন, “সদরে ১৮৫ জন চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অবকাঠামোসহ মাছের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
“সদরে ৬২টি গোদার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ৫৫টি পুকুর বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। এখনও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকার কাজ চলছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।”
লামা উপজেলার ইয়াংছা এলাকার একটি মাছের খামারের মালিক মো. ইলিয়াস খান বলেন, “আমার চারটি পুকুরে ৬ লাখ মাছের রেণু ছেড়েছিলাম। একটি মাছের রেণুর দাম এক টাকা করে হলে ৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পুকুরে এখন কোনো রেণু নেই।
“ইয়াংছাতে তালিকাভুক্ত ২০ জন খামারি আছেন। তারা সবাই মাছের রেণু চাষ করে। আমার মত তাদেরও একই অবস্থা। বন্যায় আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সরকারের কাছ থেকে কিছুটা সহযোগিতা পেলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম।”
বন্যায় শুধু মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তা নয়; ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খামারিরাও রয়েছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) পলাশ কান্তি চাকমা জানান, বন্যায় জেলাতে প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি ৫১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। তার মধ্যে খামারি পর্যায়ে ৩৮টি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ৪৫০টি গরু মারা গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হাঁস-মুরগি খামারির সংখ্যা ১৩টি। মারা গেছে ১৫ হাজার ২০০টি হাঁস-মুরগি। এ ছাড়া পশুপাখির দানাদার খাদ্য বিনষ্ট হয়েছে ১০ মেট্রিক টন।