“আমি ধারদেনা করে পেঁয়াজের চাষাবাদ করেছিলাম। এখন দেনা পরিশোধ করব কীভাবে সেই চিন্তায় ঘুম আসে না।”
Published : 20 Jan 2025, 09:57 AM
মাদারীপুর সদরের পেয়ারপুর গ্রামের কৃষক বাচ্চু হোসেন সরকারিভাবে এক কেজি পেঁয়াজের দানা বিনামূল্যে পেয়েছিলেন। ৩৩ শতাংশ জমিতে এসব বীজ রোপণ ও চাষাবাদ করতে তার খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।
কিন্তু দুই মাসের মাথায় জমিতে সেই বীজ থেকে কলির বদলে গজিয়েছে ঘাস আর আগাছা। এতে মাথায় হাত পড়েছে তার।
একই দশা মাদারীপুর জেলার পাঁচটি উপজেলার ৬০০ পেঁয়াজ চাষির।
তারা সবাই সরকারিভাবে বারি-১, বারি-৪ ও তাহেরপুরী পেঁয়াজের বীজ পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই বীজ থেকে গজায়নি চারা। এতে লোকসানের মুখে পড়া এই চাষিরা দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিপূরণের।
এ বিষয়ে মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সন্তোষ চন্দ্র চন্দ বলেন, “কেন কৃষকের জমিতে বীজ গজায়নি, সেটি বিএডিসি কর্তৃপক্ষ ভাল বলতে পারবে। আমরা শুধু তাদের বীজ এনে কৃষকদের দিয়েছি প্রদান করেছি।”
পেঁয়াজ চাষি বাচ্চু হোসেন বলেন, “সরকারিভাবে যখন কৃষি অফিসের স্যারেরা পেঁয়াজের দানা আমাকে দেয়। তখন আমি বার বার তাদের বলেছিলাম, পেঁয়াজের দানা ভালো হবে কিনা? স্যারেরা তখন বলেছিল, পেঁয়াজের দানা খুব ভাল হবে। ফলনও ভালো হবে।
“তাদের কথায় বিশ্বাস করে আমি সরকারিভাবে দেওয়া এক কেজি পেঁয়াজের দানা আমি রোপণ করেছি। কিন্তু দুই মাস হয়ে এলেও আমার জমিতে কোনো পেঁয়াজের কলি গজায়নি। গজিয়েছে ঘাস ও আগাছা।”
বাধ্য হয়ে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে নতুন করে চাষাবাদ শুরু করা এই চাষি বলেন, “এখন নতুন করে বদলা-কামলা দিয়ে জমি পরিষ্কার করছি। সরকারের কাছে আমার ক্ষতিপূরণ চাই। পেঁয়াজের জন্য যে ৪০ হাজার খরচ করেছি, তার ক্ষতিপূরণ চাই।”
পাশের বলাইকান্দি গ্রামে ২০ শতাংশ জমিতে সরকারি পেঁয়াজের বীজ রোপণ করা আরেক কৃষক মোশারফ বেপারী। তার পুরো জমিই এখন ঘাসে ভরা।
তিনি বলেন, “আমার জমিটি চকের মধ্যেখানে থাকায় অন্যের জমির উপর দিয়ে কোনো ট্রাক্টর নিয়ে নতুন করে যে চাষাবাদ করব, সেই পরিস্থিতিও নেই। এই বছর আমার জমিটা ফসলবিহীন কেটে গেল।”
চরম ক্ষতির মুখে পড়া এই কৃষক বলেন, “আমি ধারদেনা করে পেঁয়াজের চাষাবাদ করেছিলাম। এখন দেনা পরিশোধ করব কীভাবে সেই চিন্তায় ঘুম আসে না।”
একই গ্রামের আরেক পেঁয়াজ চাষি মতিউর সরদার অসকরনী বলেন, “আমি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে কয়েক দফা জমি চাষ করে সরকারি পেঁয়াজের দানা রোপণ করেছিলাম। আমার পুরা টাকাই পানিতে চলে গেছে। একটি দানাও গজায়নি। পুরা জমি খালি পড়ে আছে।”
তিনি বলেন, “সরকারি পেঁয়াজের দানা রোপণ এমন লোকসান গুনতে হবে, আগে বুঝতে পারলে কোনোদিন সরকারি পেঁয়াজের দানা চাষ করতাম না।”
মতিউর বলেন, “আমি সরকারের দাবি করছি, আমার যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতিপূরণ সরকার আমাকে যেন দেয়। তাতে আমি লোকসান কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারব।”
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, গেল নভেম্বরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বীজ সরবরাহকারী কৃষকদের মাধ্যমে সাত কোটি টাকার বারি-১, বারি-৪ ও তাহেরপুরী পেঁয়াজের বীজ কেনা হয়। যা বৃহত্তর ফরিদপুরের পাঁচ জেলার ১০ হাজার ৮২০ জন চাষির মাঝে বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
চাষিদের অভিযোগ, স্থানীয় কয়েকজন চাষি ও বিএডিসির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঠিকাদারের মাধ্যমে কোনো ধরনের ল্যাব টেস্ট ছাড়াই পেঁয়াজের নিম্নমানের বীজ সরবরাহ করা হয়। এর জন্য মূলত বীজ থেকে কলি গজায়নি।
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সন্তোষ চন্দ্র চন্দ বলেন, “বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে পেঁয়াজের দানা দেওয়া হয়েছিল, তা আমরা ছয় শতাধিক কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করি। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে, ৫২৭ জন কৃষকের জমিতে কোনো পেঁয়াজ গজায়নি।
তিনি বলেন, “পরবর্তীতে প্রণোদনা হিসেবে ৫২৭ কৃষককে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আধা কেজি করে বিনামূল্যে পেঁয়াজ দানা দেওয়া হয়েছে।”
তবে চাষিদের দাবি কারো জমিতেই পুরোপুরি বীজ থেকে চারা গজায়নি। এমনই একজন বলাইকান্দি গ্রামের গফুর মোল্লা। তার চাষ করা ৩০ শতাংশ জমিতে মাত্র ১০ ভাগ বীজ থেকে চারা গজিয়েছে।
ফরিদপুর অঞ্চলের বীজ সরবরাহকারী কৃষক নূরে আলম বলেন, “পেঁয়াজের বীজের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সব কিছু জানে স্যারেরা। তারাই ভাল বলতে পারবে কীভাবে বীজ সংগ্রহ করা হয়েছে।”
তবে উন্নত মানের বীজ সংগ্রহ করা হয়েছে দাবি করে বীজ সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজের প্রধান রফিকুল ইসলাম মুক্তা বলেন, “আমরা যখন বীজ সংগ্রহ করি তখন আমাদের কাছ থেকে বিএডিসির কর্মকর্তা বীজের স্যাম্পল সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্টে পাঠান। পরবর্তীতে ল্যাব টেস্টে আমাদের বীজ ভালো এই রকম সনদ দেন বিএডিসির কর্মকর্তারা।
“পরবর্তীতে আমরা সরকারকে বীজ সরবরাহ করি। এখন বীজ থেকে কেন চারা গজায়নি এটা ভালো বলতে পারবে বিএডিসির কর্মকর্তারা।”
তবে নিম্নমানের বীজ বিতরণের বিষয়ে ফরিদপুর অঞ্চলের বিএডিসির সহকারী পরিচালক সায়েম মল্লিক দায়সারা উত্তর দিয়ে বলেন, “ঢাকা থেকে আমাদের যে বীজ সরবরাহ করা হয়েছে আমরা সেই বীজ কৃষকদের দিতে বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়েছি। কেন গজায়নি এটা ভালো বলতে পারবে ঢাকার প্রধান কার্যালয়।”
তিনি জানান, বিষয়টির তদন্তে এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় থেকে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।
আরও খবর
প্রণোদনার বীজে গজায়নি চারা, চাষিদের মাথায় হাত
গোপালগঞ্জে প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজে 'সর্বনাশ' ৪২০ কৃষকের
রাজবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আবার পেঁয়াজ বীজ বিতরণ