এ অবস্থায় ২০২২ সালের জুনে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার কথা স্মরণ করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন জেলা মানুষজন।
Published : 18 Jun 2024, 09:21 PM
মেঘালয় থেকে আসা ভারী বর্ষণের ঢলে সুনামগঞ্জ জেলা শহরের অর্ধেক ডুবে গেছে। সীমান্ত উপজেলা ছাতকের প্রায় ৭০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশের উপজেলা দোয়ারাবাজারেরও গ্রাম-সড়কে পানি থইথই করছে।
এ অবস্থায় গত দুদিন ধরে জেলায় পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন এলাকার গ্রাহকরা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছেন।
পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে ছাতক-সিলেট সড়ক ডুবে যাওয়ায় যানচলাচল বন্ধ রয়েছে।
এ ছাড়া জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ, তাহিরপুর-বিশ্বম্ভবরপুর, জানিগাঁও-জয়নগর, সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহরের বিভিন্ন সড়কে এখন নৌকা চলছে। বন্যার্ত মানুষজন স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে সুনামগঞ্জ বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, খাদ্যগুদাম, সার গোদাম এলাকায় গিয়ে দেখা যায় অনেক স্থানেই পানি ঢুকে পড়েছে।
খাদ্য গুদামের সংরক্ষিত কক্ষের নীচে পানি রয়েছে। সামান্য পানি বাড়লেই গুদামে সংরক্ষিত খাদ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ খাদ্য গুদামের সংশ্লিষ্টরা।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে জানিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, “প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে ত্রাণ, শুকনো খাবার ও নগদ টাকা। এ ছাড়া আরও ত্রাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সুনামগঞ্জ ও ছাতকের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্ত লোকজন আশ্রয় নিয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, মনু-খোয়াই ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। নেত্রকোণা ও মৌলভীবাজারের নিচু এলাকাও বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাঁচ নদীর পানি আটটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এর মধ্যেই আগামী দুই থেকে তিন দিন উজানে ভারি বর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া কার্যালয়।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি। সুনামগঞ্জের ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে চেরাপুঞ্জির অবস্থান। সেখান থেকে ছাতক ও দোয়ারাবাজারে পানি নেমে আসতে চার ঘণ্টা এবং সুনামগঞ্জ শহরে আসতে লাগে ছয় ঘণ্টা।
এ অবস্থায় ২০২২ সালের জুনে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার কথা স্মরণ করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন জেলা মানুষজন।
ঢলের প্রভাবে এরই মধ্যে সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার এবং ছাতক পয়েন্টে ১৫৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে বলে পাউবোর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সুরমা ছাড়াও যাদুকাটা, চলতি, সোমেশ্বরী, খাসিয়ামারা, পুরাতন সুরমাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বাড়ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে মামুন হাওলাদার বলেন, “আমাদের এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হলেও মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। সোমবার সকাল ৯টা থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩৯৫ মিলিমিটার। এর আগের দুদিন যথাক্রমে ১২৬ মিলিমিটার এবং ৪৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখানে আজও ভারী বর্ষণ অব্যাহত আছে।
তিনি বলেন, যার ফলে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয় এবং সীমান্ত এলাকার রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম প্রামাণিক বলেন, “বন্যার কারণে ছাতক-সিলেট-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক বন্ধ আছে। তাছাড়া সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কও বন্ধ আছে। বন্যায় অন্যান্য সড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি বলেন, সড়ক বিভাগ বাদেও অন্যান্য দপ্তরের আভ্যন্তরীণ সড়কও প্লাবিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, “বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দোয়রাবাজার ও ছাতক উপজেলা। খাসিয়ারামা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে সীমান্তের কয়েকটি ইউনিয়নের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
“সকালে ছাতক শহরের ৭০ ভাগ ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে আরও ক্ষয়ক্ষতি হবে। আমি প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন পাঠানো ও বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর আবেদন জানিয়েছি”, বলেন সংসদ সদস্য।
হাওর আন্দোলনের সংগঠক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, চেরাপুঞ্জির অবস্থান ছাতক ও দোয়ারাবাজারের মাথার উপর। বৃষ্টি হলেই কয়েক ঘণ্টায় পানি নেমে যায়। আগে সীমান্ত নদী প্রবাহমান ছিল, সুরমা নদীরও পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি ছিল। কিন্তু এখন নদী ভরাট এবং যত্রতত্র বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ করার ফলে পানির আধার কমেছে। এতে ঢলের পানি বাধা পেয়ে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটের ক্ষতি করছে।
মূলত চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিই সুনামগঞ্জের বন্যার জন্য দায়ী বলে মনে করেন সালেহীন চৌধুরী শুভ।
সুনামগঞ্জের মধ্যবাজারের ব্যবসায়ী শুভ বণিক বলেন, শহরের ৫০ ভাগের বেশি এলাকার রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। পুরো মধ্যবাজার, পশ্চিমবাজার, সাহেববাড়ি ঘাট, উকিলপাড়া, কাজির পয়েন্ট, নবীনগর, বড়পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ডুবে গেছে।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত খালগুলো উদ্ধার করে খনন করা হলে পানি নিষ্কাশন সহজ হতো।