সিলেটের বুরজান চা-কোম্পানির তিনটি বাগানের শ্রমিকদের ১৪ সপ্তাহের বকেয়া ও রেশন বাকি পড়েছে।
Published : 24 Mar 2025, 07:40 PM
সিলেটের বুরজান চা বাগানে দৈনিক ছয় টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করেছিলেন জ্যোৎসা বেগম। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি কাজ করছেন। এই সময়ে বেতন বেড়েছে, রেশন বেড়েছে। কিন্তু ষাট বছরের জীবনে কোনোদিন টানা ১৪ সপ্তাহের বেতন বন্ধ থাকেনি জ্যোৎস্নার।
কর্মজীবনের শেষ দিকে এসে এখন ঈদের আগে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে জ্যোৎসা বেগমকে। তার ভাষ্য, “রোজার সময় বেতন বন্ধ থাকায় ঠিকমত ইফতারি খেতে পারি না। কচু শাক খেয়ে দিন পার করছি, বর্তমানে কচু শাকও পাচ্ছি না আগের মত।
“সামনে ঈদ। বেতন না পেলে বাচ্চাদের কাপড় কিনে দিতে পারব না। ঈদের পরে বেতন-বোনস দিয়ে কী হবে? ঈদে আমরা কাপড় পারতাম না। বাচ্চাদের মুখের দিকে চাওয়া যায় না।”
কথা বলতে বলতে তিনি ক্ষেপে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, “আজ বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি। আমাদের এভাবে না মেরে একবারে মেরে ফেলেন। না খেয়ে থাকতে আর পারছি না। পানি খেয়ে আর কত থাকব। আমাদের কষ্টের দিন যাচ্ছে।”
সিলেটের বুরজান চা-কোম্পানির অধীন তিনটি চা বাগান বুরজান, ছড়াগাঙ, কালাগুল ও বুরজান কারখানার শ্রমিকদের ১৪ সপ্তাহের বকেয়া এবং রেশনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শ্রমিকেরা।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে নগরীর লাক্কাতুরা এলাকা থেকে মিছিলটি বের হয়ে বন্দরবাজারের সিলেট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে দুই ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ করেন চা শ্রমিকেরা। কর্মসূচি চলাকালে শ্রমিক জ্যোৎসা বেগম তার ক্ষোভের কথা বলেন।
এ সময় ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই কর’, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘আমাদের বেতন দিতে হবে, দিয়ে দাও’, ‘বকেয়া বোনাস পরিশোধ করতে হবে’, ‘বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে’, ‘আমাদের বেতন দিয়ে দাও, দিতে হবে’- এসব স্লোগানে-স্লোগানে চারপাশ মুখরিত করে চা শ্রমিকেরা।
শ্রমিকরা বলেন, বেতন ও রেশন না পাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন তারা। বুরজান চা-কোম্পানির অধীনে থাকা আড়াই হাজার শ্রমিকের বেতন-রেশন ও বোনাস বকেয়া পড়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা তিন বেলা খাবার খেতে পারছে না। পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে। মলিকপক্ষ বেতন দিচ্ছে-দিচ্ছে বলে যাচ্ছে। কবে তাদের বেতন দেবে তার ঠিক নেই।
বিক্ষোভ চলাকালে দুপুর ২টার দিকে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার উজ জামান শ্রমিকদের সামনে উপস্থিত হন। তিনি এ সময় বৃহস্পতিবার শ্রমিকদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান।
ফাগুয়ার রং লাগেনি গৌরীর, তানজিনার চিন্তায় ঈদ
শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ঈদের পর শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও রেশনের সমস্যার সমাধান হবে।”
বুরজান চা বাগান কোম্পানির ব্যবস্থাপক মো. কামরুজ্জামান বলেন, “যেসব চা বাগানে সমস্যা রয়েছে, সেসব বাগানের লোকদের নিয়ে রোববার চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ সভা করেছে। চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ আমাদের ঋণ দেওয়ার জন্য কৃষি ব্যাংককে সুপারিশ করবে। আশা করছি, দ্রুতই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, চা পাতার দাম না বাড়ায় বর্তমানে বাগান লোকসানে আছে। বাগানের শুধু শ্রমিকদের বেতন বন্ধ হয়নি; বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও বন্ধ রয়েছে।
বেতন বন্ধ থাকায় চা শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন যাপন করছে জানিয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা বলেন, “আজকে আমরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছি। জেলা প্রশাসক বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলেছেন।’’
‘আমাদের শোষণ করা হচ্ছে’
কালাগুল চা বাগানের নারী শ্রমিক শিলা নায়েক (৩৫) বলেন, “আমরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করি। কিন্তু আমরা বেতন পাচ্ছি না। ১৪ সপ্তাহ ধরে বেতন পাচ্ছি না, রেশন পাচ্ছি না। আজ দেব, কাল দেবে- এই বলছেন বাগানের বাবুরা। না দিয়ে তারা বিদেশ চলে যায়, এরা হলো শোষণকারী। আর ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। সরকার আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। দিনের পর দিন আমাদের শোষণ করা হচ্ছে।
তিনি বলছিলেন, “আমাদের দয়া করে একটু সাহায্য করুন। যাতে আমাদের বকেয়া বেতন-বোনাস পেতে পারি। আমাদের চা বাগানে আগের মত কাজ করতে পারি। কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।”
একই কথা বলছিলেন শ্রমিক আয়না নাহারও (৫০)।
বুরজান কারখানা শ্রমিকদের পঞ্চায়েত সভাপতি বিলাশ বুনাজী বলেন, “জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যাতে বাগানটা চলমান থাকে, বেতন-ভাতা চালু থাকে- সেজন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন।
“যদি ঈদের পরে সমস্যার সমাধান না হয়; তাহলে সিলেটের ২২টি বাগানের পক্ষ থেকে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।”