সিলেটের বুরজান চা বাগানের শ্রমিকরা বলেন, ১৩ সপ্তাহের বেতন বাকি; আট সপ্তাহ ধরে রেশন নেই।
Published : 16 Mar 2025, 12:31 AM
অন্যান্য জায়গার মত সিলেটের চা বাগানগুলোতেও শুরু হয়েছে ফাগুয়া বা দোল উৎসব। তিথি অনুযায়ী, আগের দিন মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া দোলের রং শুক্রবার সারাদিনও মেখেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। চা শ্রমিকদের বছরের সবচেয়ে বড় এ উৎসবে বাগান মেতে থাকবে রোববার পর্যন্ত।
তবে বুরজান চা বাগানের শ্রমিক গৌরী নায়েকের (৫০) সংসারে এবার ‘রং পরব’ বা ফাগুয়া উৎসবের ‘রং’ নেই; দোলের রংয়ে এবার সাজেনি তার মন। কারণ মা হয়েও দুই শিশুর হাতে মেলায় যাওয়ার জন্য দুটি টাকা তুলে দিতে পারেননি তিনি। অন্য বাগানের ছেলেমেয়েরা উৎসবে মেতেছে। কিন্তু গৌরীর দুই সন্তান মনমরা হয়ে বাড়িতেই বসা।
চার সদস্যের পরিবারের কর্ত্রী গৌরী শনিবার দুপুরে বলছিলেন, “আমাদের ১৩ সপ্তাহ ধরে (তিন মাসের বেশি) বেতন নাই, রেশনও বন্ধ। ফাগুয়ার মধ্যে বাচ্চারা কান্না করছে নতুন জামার জন্য। বাচ্চাদের কী বলে বুঝাব? আমরা কী করে বাঁচব? আমরা গরিব মানুষ, প্রতিদিন আনি প্রতিদিন খাই। এভাবে আর চলতে পারছি না।”
একই বাগানে যে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম শ্রমিক আছে তার মধ্যে তানজিনা বেগমের (৪০) পরিবার প্রায় দেড় দশক ধরে বাগানে কাজ করছেন। পাঁচজনের সংসারের অনেকটাই এখন তার কাঁধে।
রোজার মাসে এসে তানজিনাও পড়েছেন মজুরি আর রেশনের অভাবের মধ্যে। রোজাটা কোনো রকমে কষ্টেসৃষ্টে পার করতে পারলেও তার চিন্তায় বাচ্চাদের ঈদ।
তানজিনা বলছিলেন, “রোজার সময় আমরা কষ্ট করছি। কিন্তু ঈদের আগে বেতন না পেলে বাচ্চাদের নিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না। আমরা চলার কোনো পথ পাচ্ছি না।”
“কোম্পানির লোকজন আজ না কাল বলে যাচ্ছে। আমাদের রোজার ঈদের বোনাস বকেয়া আছে। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে পরিবার চলে না, এর মাঝে বেতন বন্ধ হলে আমরা চলি কীভাবে?”
সদর উপজেলার বুরজান চা বাগানের শ্রমিক ও কর্মকর্তারা বলেন, বিভিন্ন সময়ে তাদের ছয় সপ্তাহের মজুরি বাকি পড়েছিল। এখন টানা ছয় সপ্তাহ বকেয়া পড়েছে। এছাড়া আট সপ্তাহ ধরে তাদের কোনো রেশন নেই।
বুরজান চা কোম্পানির অধীন তিনটি চা বাগান- বুরজান চা বাগান, ছড়াগাঙ চা বাগান ও কালাগুল চা বাগান। এছাড়া তাদের একটি কারখানাও আছে। তিনটি চা বাগান ও কারখানা মিলিয়ে আড়াই হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন।
বেতন-রেশন বন্ধ থাকায় চা শ্রমিকরা ঠিকমত খেতেও পারছেন না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা।
তিনি বলেন, “বুরজান কোম্পানিতে তিন মাসের উপরে বেতন বকেয়া পড়েছে। কোম্পানির জিএম নেই বাগানে। শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। ফাগুয়া উৎসবের জন্য বাগান বন্ধ রয়েছে। সোমবার বাগান খুললে মঙ্গলবার থেকে বকেয়া বেতন ও রেশনের দাবিতে কর্মবিরতিতে যাবেন শ্রমিকরা।”
মালিক পক্ষ আজ না কাল বলে সময় পার করছে। কিন্তু শ্রমিকরা বেতন-রেশন পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে বকেয়া মজুরি ও রেশন পরিশোধ, অগণতান্ত্রিক গেজেট-২৩ বাতিল, দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা নির্ধারণ এবং ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে সিলেট নগরীতে সমাবেশও করেছেন চা শ্রমিকরা।
’কার কাছে গিয়ে কান্না করব সেটা বুঝতেছি না’
বুরজান চা বাগানেই দুই দশক ধরে স্বামীকে নিয়ে শ্রমিকের কাজ করছেন রেহেনা বেগম। তাদের পাঁচ সদস্যের পরিবার সাপ্তাহিক মজুরি আর রেশনের উপরই নির্ভরশীল। ২০ বছরে এমন দীর্ঘ সময় ধরে সংকটের মুখোমুখি হননি কোনোদিন।
রেহেনা বেগম বলছিলেন, “গতবার ফাগুয়া উৎসব থেকে আমাদের বাগানে বেতন নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছে; এখনও চলছে। আমার ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ে। তাদের বেতন দিতে পারছি না। এই অবস্থায় দিন পার করছি।”
বুরজান চা বাগান কোম্পানির অধীন কালাগুল চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি রঞ্জু নায়েক। তিনি জানাচ্ছিলেন, কোম্পানি আগে এক সপ্তাহ বেতন দিয়ে, আরেক সপ্তাহ বন্ধ রাখত। এভাবে করতে করতে ছয় সপ্তাহের বেতন বকেয়া পড়েছিল। আর বর্তমানে টানা ছয় সপ্তাহ ধরে বেতন ও রেশন বন্ধ রয়েছে। কোম্পানির হাসপাতালে কোনো ওষুধও নেই।
পঞ্চায়েত সভাপতি বলেন, “কোম্পানি বলছে, ব্যাংক লোন পেয়ে টাকা দেবে। লোন কবে পাবে আর কবে দিবে সেটা বুঝতেছি না। আমাদের গত বছর এবং এই বছরের ফাগুয়া উৎসবের বোনাস পাইনি।”
এর মধ্যে শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ও রেশনের দাবিতে সিলেটের ডিসির কাছে লিখিতও দিয়েছে। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি।
হতাশা নিয়ে রঞ্জু নায়েক বলছিলেন, “এখন কার কাছে গিয়ে কান্না করব সেটা বুঝতেছি না। আর মুসলিম শ্রমিকের সামনে ঈদ; তাদের বেতন বন্ধ রয়েছে। তবে আমরা শ্রমিকরা বুঝিয়ে বাগানের কাজ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
মঙ্গলবার থেকে শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে যাবে- এ তথ্য জানিয়ে পঞ্চায়েত সভাপতি বলেন, “গরিব মানুষ, দেখেন না ভাই, কিছু করা যায়নি।”
তবে মালিক পক্ষ যে বেতন ও রেশনের আশ্বাস দিচ্ছে, তাতে আস্থা রাখতে পারছেন না বুরজান চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি সুবাস নায়েক রতিলাল। তিনি বলছিলেন, “শ্রমিকদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। কোম্পানি বলছে দেবে, তারা দিতে-দিতে আমাদের অবস্থা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দুঃখ দেখার কেউ নেই।”
ছড়াগাঙ চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি কমল চাষা বলেন, “কোম্পানি লোনের টাকা কবে পাবে তার ঠিক নাই, আমাদের শুধু আশা দিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবারও বেতন পাওয়ার কথা ছিল, সেদিনও পাইনি। তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের কেউ এক কেজি চালও দেয়নি। বর্তমানে চা শ্রমিকদের অনেকে বাহিরে কাজ করছে। আর যারা বাহিরে কাজ করতে পারে না তারা না খেয়ে আছে।”
অনেক শ্রমিকের ঘর ভেঙে গেছে, কোম্পানি সেগুলো ঠিক করে দিচ্ছে না জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমল চাষা। বলেন, “ছড়াগাঙ চা বাগানে শ্রমিকদের ৩০০ ঘরের মধ্যে একটি ঘরও ঠিক করে দেয়নি কোম্পানি। এখন বৃষ্টির দিনে শ্রমিকেরা কিভাবে থাকবে। বৃষ্টি হলেই শিলও পড়ে। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা, দেখেন আমাদের জন্য কিছু করা যায়নি।”
প্রায় একই ধরনের সমস্যার কথা জানিয়ে আকুতি করছিলেন বুরজান চা বাগানের শ্রমিক রাসেল মিয়াও।
ঋণের অপেক্ষায় বাগান
শ্রমিকদের বেতন ও রেশন পরিশোধের জন্য ব্যাংক ঋণের আবেদন করা হয়েছে জানিয়ে বুরজান চা বাগান কোম্পানির ব্যবস্থাপক মো. কামরুজ্জামান বলেন, “চা বাগান চলে ব্যাংকের ঋণে। আমরা ব্যাংক ঋণের জন্য অপক্ষো করছি। ব্যাংক ঋণ পেয়ে গেলে বকেয়া দিয়ে দেওয়া হবে।
“চায়ের পাতার দাম না বাড়ায় বর্তমানে বাগান লোকসানে আছে। বাগানের শুধু শ্রমিকদের বেতন বন্ধ হয়নি; বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও বন্ধ রয়েছে।”
এ বিষয়ে সিলেটের ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, “শ্রমিকরা বলেছেন, তারা নিয়মিত বেতন-রেশন পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হয়েছে। কোম্পানি একটি ঋণের জন্য অপেক্ষা করছে। ব্যাংক ঋণ পেয়ে গেলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
চা শ্রমিকদের একজন নেতা বলেন, চা বাগানগুলো লোকসানের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, পাতার দাম কম হওয়া। বাজারে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে নিলামে চায়ের পাতা বিক্রি করেন বাগান মালিকরা। অনেক সময় দেখা যায়, উৎপাদন খরচই এর চেয়ে বেশি।
এখানে নামেমাত্র কয়েকটি কোম্পানির সিন্ডিকেট চলছে বলেও মনে করেন ওই শ্রমিক নেতা। তিনি বলেন, নিলামে যে দামে চা বিক্রি হয় কোম্পানির চায়ের দাম তার চেয়ে তিন-চারগুন বেশি।
শ্রমিক সমাবেশ
বুরজান-ছড়াগাঙ-কালাগুল চা বাগান ও ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ও রেশন পরিশোধসহ পাঁচ দফা দাবিতে সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন।
বুধবার সিলেট নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এবং ৭ মার্চ তারা নগরীর লাক্কাতুরা এলাকায় বিভাগীয় স্টেডিয়ামের টিকেট কাউন্টারের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ৫ অগাস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে শ্রমিকরা। বস্তুত এই সংকট তৈরি হয়েছে বাগান মালিকের অনুপস্থিতির কারণে। সামনে বর্ষাকাল বাগানে পাতা উত্তোলনের সময় এ রকম সময়ে শ্রমিকরা মজুরি থেকে বঞ্চিত হলে বাগানে কাজ করতে আগ্রহ হারাবে; যা বাগান বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করবে।