বাধ্য হয়েই স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অতৃপ্তি নিয়ে খোলা সয়াবিন তেল কিনে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন গ্রাহকরা।
Published : 06 Mar 2025, 12:09 PM
কুড়িগ্রামের বাজারে মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল। অত্যাবশ্যকীয় এই ভোগ্যপণ্যের সংকটে চরম ভোগান্তিতে ভোক্তারা। তবে একে ‘কৃত্রিম সংকট’ বলে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ী ও পরিবেশকরা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট পরিবেশকদের কাছে বোতলজাত সয়াবিন চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে কোম্পানি প্রতিনিধিরা বলছেন- খোলা তেলে লাভ বেশি হওয়ায় দোকানিরা বোতলের তেল খুলে বিক্রি করছেন কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত।
কুড়িগ্রাম শহরের জিয়া বাজারে তেল কিনতে আসা আনিছুর রহমান বলেন, “রমজান মাস আসলেই জনগণের ভোগান্তি বাড়ে। জিনিসের দাম তো বেশি হয়, সঙ্গে সংকটও তৈরি হয়।
“ইফতারসহ রান্নার কাজে সয়াবিনের ব্যবহার একটু বেশি হয়। সব পরিবারে একই রকম। কিন্তু বোতলের তেল কোথাও নেই। খোলা তেল নিয়ে বাড়ি ফিরছি।”
আরেক গ্রাহক আমিনা বেগম বলেন, “বোতলের সয়াবিন কিনতে আসছি। কোথাও পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে খোলা তেল কিনলাম।”
কুড়িগ্রাম শহরের আদর্শ পৌর বাজারের ব্যবসায়ী নাঈম ইসলাম বলেন, “অনেক দিন থেকেই কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ করছে না। গ্রাহকরা বারবার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাবি করলেও দিতে পারছি না। বাধ্য হয়েই গ্রাহকরা খোলা তেল নিয়ে ফিরছেন।”
শহরের সুপার সপসহ একাধিক বাজারের বেশ কয়েকটি পাইকারি এবং খুচরা বিক্রেতাদের দোকান ঘুরে এই ব্যবসায়ীর কথার সত্যতা পাওয়া যায়। কোনও দোকানে বোতলজাত সয়াবিন পাওয়া যায়নি। দুই একটি দোকানে ভেজিটেবল অয়েলের বোতল পাওয়া গেলেও তার সংখ্যা সীমিত।
ফলে বাধ্য হয়েই স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অতৃপ্তি নিয়ে খোলা সয়াবিন তেল কিনে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন গ্রাহকরা।
বোতলজাত সয়াবিন না থাকলেও খোলা সয়াবিন সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। প্রতি লিটার খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৯০ টাকায়।
একইসঙ্গে রমজান শুরুর পরই আলু, কপি, লেবু, বেগুনসহ বেশকিছু পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও ভোজ্য পণ্যের ভোগান্তি নিয়েই ভোক্তাদের শুরু করতে হয়েছে রমজান।
তবে সরকারি সংস্থাগুলোর দাবি অন্য সময়ের তুলনায় এবার রমজানে বেশির ভাগ পণ্যের দাম নাগালে রয়েছে।
সোমবার এক সভায় সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও বাজার কমিটির প্রতিনিধিদের নিয়ে রমজানের কুড়িগ্রামের বাজার মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়।
সভায় জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন, “যে কোনো মূল্যে বাজার স্থিতিশীল রাখা হবে। এছাড়া তিন মাস আগে থেকে বাজার মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলার সর্বত্র দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং হচ্ছে। কোথাও অসংগতি দেখা দিলে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “বাজারে কোনো ধরনের কারচুপি, অতিরিক্ত মূল্য আদায়, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবসায়ীদের আর্থিক জরিমানা ছাড়াও কারাদণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ”
বোতলজাত তেল পেতে নানা শর্ত: অভিযোগ ব্যবসায়ীদের
কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট পরিবেশকদের কাছে তারা বারবার তাগিদ দিয়েও বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ পাচ্ছেন না দাবি করছেন কুড়িগ্রামের খুচরা ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা।
আদর্শ পৌর বাজারের ব্যবসায়ী নাঈম ইসলাম বলেন, “কোম্পানিগুলো বোতলজাত তেল দিতে নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এক কার্টন তেল নিতে এক বস্তা প্যাকেট চাল, আটা কিংবা সরিষার তেল নেওয়ার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এসব শর্ত দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব না।”
শহরের মুদি দোকানি আয়নাল হক বলেন, “কোম্পানির অন্য পণ্য নেওয়ার শর্ত ছাড়া বোতলজাত সয়াবিন মিলছে না। কোম্পানিগুলো শর্তের জালে দোকানদারদের জিম্মি করছে। ডিলারদের ফোন দিলে বলছে তেল নাই।”
একই কথা বলেছেন জিয়া বাজারের আরেক মুদি দোকানি আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, “কয়দিন আগে রূপচাঁদা কোম্পানির এসআর এসে এক কার্টন তেলের সঙ্গে এক বস্তা প্যাকেট চাল নেওয়ার শর্ত দিয়ে গেছেন। নিতে পারি নাই।”
ব্যবসায়ীদের আরও অভিযোগ, শর্তে রাজি হলেও দুই কার্টনের বেশি তেল দিতে চাইছেন না প্রতিনিধিরা। ফলে গ্রাহকরা বোতলজাত সয়াবিন পাচ্ছেন না।
পাল্টা অভিযোগ কোম্পানি প্রতিনিধিদের
তবে ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে সরবরাহ কমের দাবির পাশাপাশি পাল্টা অভিযোগও করছেন কোম্পানি প্রতিনিধিরা।
কুড়িগ্রামে ফ্রেশ সয়াবিন তেলের ডিলার দবির হোসেন। যোগাযোগ করলে তার ম্যানেজার পাপ্পু বলেন, “কোম্পানি তেল না দিলে আমরা কী করবো। আমরা বারবার তেল চেয়েও পাচ্ছি না। তারা বলছে, তাদের তেলের সরবরাহ কম। আপনারা কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেন।”
রূপচাঁদা কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি সাব্বির বলেন, “আমরা তেল পাওয়ামাত্র মার্কেটে ছাড়ছি। সরবরাহ তুলনামূলক কম হলেও আমরা আটকে রাখছি না।
দোকানদারদের অভিযোগের বিষয়ে এই বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, “বোতলজাত তেলের চেয়ে খোলা বিক্রিতে লাভ বেশি। দোকানিরা বোতলের তেল খুলে বিক্রি করছেন কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত।”
তিনি বলেন, “জিয়া বাজার, পৌর বাজার, খলিলগঞ্জ বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে বোতলজাত তেল দিয়েছি। আমার কাছে প্রত্যেকটার বিক্রয় স্লিপ আছে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন বাজারে চাহিদাপত্র নিয়েছি। এগুলো সরবরাহ করা হবে।”
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) উত্তম কুমার রায় বলেন, “বোতলজাত সয়াবিনের সংকটের বিষয়টি আমাদের জানা আছে। আশা করি দ্রুত এর সমাধান হবে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
“এছাড়া আমরা টিসিবির পণ্য পেয়েছি, সেগুলো বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রিও শুরু হয়েছে”, যোগ করেন তিনি।