জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, জেলাজুড়ে মৎস্য খাতে ৫০ কোটি ৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
Published : 06 Oct 2024, 09:59 PM
অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। তিন উপজেলার ২১ ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
এ ছাড়া তিন উপজেলাতেই বিদ্যুৎ সংযোগ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপাকে পড়েছেন মানুষজন।
রোববার দুপুরে এসব তথ্য জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন।
ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, “অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সাত হাজার ৮০ জন মৎস্য চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সবমিলিয়ে ৫০ কোটি ৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখন নারী-শিশুসহ দেড় সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
তিন উপজেলায় ৩০ মেট্রিক টন চাল খাদ্য সহায়তা দিয়েছে প্রশাসন। দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ চলছে। এ ছাড়া রান্না করা খাবারও দেওয়া হচ্ছে বন্যা দুর্গতদের।
তবে, এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধোবাউড়ায় শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। তবে কিছু এলাকায় খাবারের ব্যবস্থা করছে প্রশাসন।
এ ছাড়া নেতাই নদীর আশপাশের এলাকায় অর্ধশত ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। উপজেলার কলসিন্দুর, জিগাতলা, পঞ্চনন্দপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে ফুলপুর উপজেলার ছনধরা, রামভদ্রপুর, সিংহেশ্বর, ফুলপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ও অন্যান্য ইউনিয়নের আংশিক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার আমন ফসল ও সবজি খেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের খামার।
উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও-বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
এ ছাড়া হালুয়াঘাটের প্রায় সব ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান, সবজি খেত এবং ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে আছে হাজার হাজার মানুষ। ঘরের মধ্যে পানি ঢোকার কারণে রান্নার কাজও ব্যাহত হচ্ছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে মানুষজন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাছিনা আক্তার বানু বলেন, ধোবাউড়া উপজেলায় নিমজ্জিত ধান ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর, সম্পূর্ণ নিমজ্জিত সাত হাজার ৫০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত চার হাজার ২০০ হেক্টর ও সবজি ৬০ হেক্টর।
হালুয়াঘাটে নিমজ্জিত ধান সাত হাজার ৬০০ হেক্টর, সম্পূর্ণ নিমজ্জিত চার হাজার ১০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত তিন হাজার ৫০০ হেক্টর এবং সবজি ৭৫ হেক্টর।
ফুলপুরে নিমজ্জিত ধান তিন হাজার ৬৩০ হেক্টর, সম্পূর্ণ নিমজ্জিত এক হাজার ৪৮০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত দুই হাজার ১৫০ হেক্টর এবং সবজি ৬২ হেক্টর।
বন্যার পানিতে ধোবাউড়া উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়নের ডৌমঘাটা গ্রামের কবির সারোয়ার সুজনের তলিয়ে গেছে ৪০ একর মাছের খামার এবং দেড়শ একর জমির ধান।
কবির সারোয়ার সুজন বলেন, “৪০ বছর ধরে মাছ চাষ করে আসছি। জীবনে কখনো এমন পরিস্থিতির শিকার হইনি। চোখের সামনে ছয়টি পুকুরের ৪০ লাখ টাকার কার্প জাতীয় মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে। তিনদিন ধরে পানিতে তলিয়ে আছে দেড়শ একর জমির ধান। সবি শেষ হয়ে গেল, সরকার সহযোগিতা না করলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।”
উপজেলার আমতৈল গ্রামের সিদ্দিক মিয়া বলেন, “রাস্তাঘাটে পানি, থাকার ঘর, রান্নাঘরেও পানি। এখনো কোনো শুকনা খাবার পেলাম না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।”
কৈচাপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, “এমন বন্যা আগে কখনও দেখিনি। ১৯৮৮ সালের বন্যা দেখেছি, এমন পানি ছিল না। বাড়িঘরে পানি ওঠেছে। গরু-ছাগল নিয়ে বিপদে আছি। গরু পানির মধ্যে বাঁধা।
“আমরা খুব সমস্যায় আছি। চলাফেরা খুব সমস্যা, রাস্তায় বুক সমান পানি। ফসলের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান পানির নিচে পড়ে গেছে। এবার আমন ধান পাব, এমন আশা করা যায় না। অনেক শাক-সবজির জমি তলিয়ে গেছে।”
রোববার সকালে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, “আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। বন্যাদুর্গত মানুষের খাদ্যসহ, যে চাহিদা সে মোতাবেক সরকার আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সহায়তা দিয়েছে।
উপজেলাগুলোতে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে জানিয়ে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, “আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষের জন্য রান্না করা খাবার ও শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। আবহাওয়া কার্যালয় বলছে, আরও একদিন বৃষ্টি থাকতে পারে।”
এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, “এরকম পানি ১৫-২০ বছরে আমরা দেখেনি। এখানে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, মানুষের বাড়িঘর, জমির ফসল, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সব নষ্ট হয়ে গেছে। এমন একটা পরিস্থিতির জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।
“আমরা নিজেদের যা সামর্থ্য আছে সেটা নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছি। আমরা প্রথম দিন থেকেই মানুষকে উদ্ধার, আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, খাবার বিতরণ করে আসছি। ক্ষতিগ্রস্ত লোকের তালিকা করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।”
আরও পড়ুন:
পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে ময়মনসিংহে অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত
বন্যা: ময়মনসিংহে ৫০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি
শেরপুরের বন্যা ছড়িয়েছে ৫ উপজেলায়, ফসল ও মাছের ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি
শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, পানিবন্দি ৮৫০ জনকে উদ্ধার
শেরপুরের বন্যা: মৃত্যু বেড়ে চার, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
শেরপুরের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি '১৮ ঘণ্টার মধ্যে'
শেরপুরের বন্যায় আরেক জনের মৃত্যু, নিখোঁজ তিন
শেরপুরের বন্যার পানিতে বৃদ্ধের মৃত্যু
বৃষ্টি আর ঢলে শেরপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, পানিবন্দি ৭ ইউনিয়নের হাজারো মানুষ