“বাসমতিতে বিঘা প্রতি উৎপাদন হবে ২৫ থেকে ৩০ মণ কিন্তু এর বাজারমূল্য অন্তত এক লাখ টাকা।”
Published : 24 Apr 2025, 10:40 AM
বিদেশি জাতের বাসমতি ধান আবাদ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাগেরহাটের ফকিরহাটের আইন পড়ুয়া এক চাষি। উচ্চমূল্যের এ ধান চাষে সফলতায় তিনি প্রত্যাশা করছেন বেশি মুনাফার।
প্রথমবারের মতো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ‘পাকিস্তানি লং বাসমতি-১১২১’ জাতের এ ধানের চাষ করে সফল হয়েছেন দাবি করে এই তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সফলতার সে হাসি ছড়িয়ে দিতে চান অন্য কৃষকদের মাঝেও।
তার আশা ইরি, বোরো, আমনের আবাদ করে সীমিত লাভ পাওয়া চাষিরাও এই ধানের চাষ করে বেশি মুনাফার মুখ দেখতে সক্ষম হবেন।
ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের মাসকাটা গ্রামের বাসিন্দা কামরুজ্জামান সোহেল নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের খুলনা ক্যাম্পাসের এলএলবি শেষ বর্ষের ছাত্র।
কয়েকবছর ধরে কৃষিভিত্তিক নানা উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত এই তরুণ বলেন, “এই ধানের সঙ্গে হাইব্রিডের পার্থক্য হলো হাইব্রিড বিঘাপ্রতি ৩৫-৪০ মণ উৎপাদন হয়, তবে তার বাজারমূল্য ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। বাসমতিতে বিঘা প্রতি উৎপাদন হবে ২৫ থেকে ৩০ মণ কিন্তু এর বাজারমূল্য অন্তত এক লাখ টাকা।”
কৃষি বিভাগও বলছে, বর্তমানে বাসমতি চাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, ফলে বাজারে এই চাল উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। স্থানীয় কৃষকরাও এই ধানের আবাদ করলে লাভবান হবেন। দেশে উৎপাদন বাড়লে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব।
সম্প্রতি মাসকাটা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সোহেলের বাড়ির সামনের এক একর জমি সোনালী ধানে ভরে গেছে। মাঠ জুড়ে শীষে শীষে দুলছে ধান। ধানের ভারে নুয়ে পড়া ধানগাছ কাটার উপযোগি হয়ে উঠেছে।
কামরুজ্জামান সোহেল বলেন, “এই জমিতে পাকিস্তানি লং বাসমতি-১১২১ জাতের ধান রোপন করেছি। একর প্রতি চল্লিশ হাজারের মত খরচ হয়েছে। আমি সফল হয়েছি। ভাল ফলন হয়েছে। এখন ধান কাটার উপযোগী হয়ে উঠেছে।”
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েক বছর ধরে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেদের জমিতে ধানের আবাদ করছি। কিন্তু হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ করতে যে পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয় সেই তুলনায় মুনাফা আসে না।
“তখন মাথায় আসল- পোলাও-বিরানীতে বাসমতি চাল ব্যবহার করা হয়। এসব সুগন্ধি চালের দাম কেজিপ্রতি চারশ টাকা পর্যন্ত আছে। তাই পাকিস্তানের লং বাসমতি-১১২১ জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করে বীজতলা তৈরি করে পরীক্ষামূলকভাবে আমার এক একর জমিতে আবাদ করেছি।”
নিজের প্রচেষ্টায় এই ধানের আবাদ করতে হয়েছে জানিয়ে এই তরুণ চাষি বলেন, “শুরুতে এই ধান নিয়ে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। এই ধানের আবাদ কেউ আগে করেনি, অন্য কারও থেকে সেভাবে সহযোগিতাও আমি পাইনি।
“আবাদের বিষয়টি আমি কৃষি বিভাগকে জানালে একবার তারা পরিদর্শনে এসে বলেন তারা এই জাতের বিষয়ে খুব একটা কিছু জানেন না।”
দেশের বাইরে থেকে এই ধানের বীজ সংগ্রহ করেছেন জানিয়ে সোহেল বলেন, “বড় ভাইয়ের চাকরির সুবাদে দেশের বাইরে থেকে পাকিস্তানের লং বাসমতি-১১২১ জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করেছি। তবে এখন আমার মাধ্যমে অন্য কৃষকরাও এ বীজ পেয়ে যাবেন।”
এই জাতটি দেশের কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমানে সুগন্ধি চাল ভারত ও পাকিস্তান থেকে আসে। আমি দক্ষিণাঞ্চলে প্রথম আবাদ করলাম। আমি চাই আমার মাধ্যমে সব কৃষক এই ধানের আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠুক এবং ভাল মুনাফা করুক। আমরা উৎপাদন করলে দেশের মুনাফা দেশেই থাকবে।”
তরুণ এই কৃষি উদ্যোক্তা বলেন, “আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর দেশ, নতুন উদ্যোগকে যদি কাজে না লাগাই তাহলে উন্নয়ন আশা করব কী করে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধানের আবাদ কম লবণাক্ত এলাকায় হবে, তবে মাত্রাতিরিক্ত লবণযুক্ত এলাকার জমিতে হবে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
এই সুগন্ধি ধান জাতের আবাদে সোহেলের এই সফলতা স্থানীয় কৃষকদেরও আশা জাগাচ্ছে। তারাও আগামীতে এই জাতের ধান আবাদ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
সোহেলের প্রতিবেশি কৃষক মামুন শেখ, সোলাইমান শেখ ও হালিম শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে ইরি, বোরো, আমন ধানের আবাদ করছেন। কিন্তু তাতে তাদের লাভ হয় সীমিত। তরুণ কৃষক সোহেল যে ধানের আবাদ করেছে এই ধানের জাত-আগে পরে কখনো দেখেননি।
মামুন শেখ বলেন, “বাসমতি ধানের আবাদ করে সোহেল আমাদের অবাক করে দিয়েছে। এই ধানের বিশেষত্ব হচ্ছে সুগন্ধ। আবাদ ভাল হলে এই ধানে লাভ হাইব্রিডের থেকে কয়েকগুণ বেশি হবে। তাই আগামীতে আমরাও বাসমতি ধানের আবাদ করব।”
ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাখাওয়াত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলেই পাকিস্তানি লং বাসমতি (সুগন্ধি চাল) ১১২১ ধানের আবাদ প্রথম হল। যা বাগেরহাটের ফকিরহাটেই আবাদ হয়েছে।
তিনি জানান, পাকিস্তান আর্কাইভের তথ্যমতে লংগেজ বাসমতি সুগন্ধি ধান। সুগন্ধ ও স্বাদের জন্য বিশ্বব্যাপি লং বাসমতির প্রচুর চাহিদা আছে। আমাদের দেশেও বাসমতি চালের বিরিয়ানি-পোলাও ভাত খুব জনপ্রিয়।
মূলত পাকিস্তানে ও ভারতে উৎপাদন হওয়ায় আমদানি করা চালেই দেশের চাহিদা মেটানো হয়। দেশের বাজারে এ চাল কেজিপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাখাওয়াত বলেন, মাসকাটা গ্রামের কামরুজ্জামান সোহেল প্রথমবারের মতো পরীক্ষমূলকভাবে এ ধানের আবাদ করেছেন, ভাল ফলন হয়েছে।
“তার সফলতায় এই ধান চাষে অন্য কৃষকরাও আগ্রহী হবে। ধান যে একটি উচ্চমূল্যের ফসল হতে পারে বাসমতি সে উদাহরণ হবে। আগামীদিনে এ ধান চাষীদের জন্য রঙ্গিন স্বপ্ন বয়ে আনবে।”
বাসমতি ধানের জাতটির বিষয়ে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, আগামী সোমবার ধানের মাঠ পরিদর্শনে আসার আগ্রহ দেখিয়েছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা। তারা ধানের জাতটির বিশুদ্ধতা ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে জানাবে। তারা এই ধানের জাতের সার্টিফিকেশন দিলে দক্ষিণের সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে পারব।
এই ধানের আবাদ করলে কৃষক লাভবান হবে আশা করে শেখ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই ধানের আবাদ সম্প্রসারিত ও কৃষক পর্যায়ে আগ্রহী করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সফল হওয়া চাষীকে ধানের বীজ সংরক্ষণের জন্য পরামর্শ দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, “বাগেরহাট লবণাক্তপ্রবণ এলাকা। কৃষক সোহেলের আবাদকৃত মাটি সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হবে- জাতটি কতটা লবণসহিষ্ণু।”
লবণসহিষ্ণু এলাকায় ধানের আবাদটি ছড়িয়ে দিতে পারলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভাগ্যবিড়ম্বিত কৃষি ও কৃষক আগামীতে সুদিন দেখতে পারবে বলেও আশা এই কৃষি কর্মকর্তার।