“আমার বাবার তো কোনো অপরাধ ছিল না। এখন কীভাবে চলবে আমাদের সংসারের খরচ?”
Published : 29 Jul 2024, 01:01 AM
পরিবারের জন্য উপার্জন করার একমাত্র সম্বল পুরনো একটি মাইক্রোবাস। সেটি ভাড়ায় খাটিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতেন কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার মো. তাজুল ইসলাম। সবার ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করা একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা পরিবার।
রোববার সকালে কথা হয় তাজুলের একমাত্র ছেলে রোদোয়ান আহমেদ সিয়ামের সঙ্গে। ১৫ বছর বয়সী সিয়াম চোখের জলে বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন।
সিয়ামের ভাষ্য, তার বাবার রেন্ট-এ কারের ব্যবসায়ী ছিলেন। ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায় তার অফিস ছিল। ১৮ জুলাই ওই এলাকার ‘আমির কমপ্লেক্সের’ সামনে কোথাও থেকে গুলি এসে লাগলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি।
বুকের ভেতর গুলি রেখেই ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরদিন বরুড়া উপজেলার উত্তর শিলমুড়ি ইউনিয়নের গামারোয়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে ৫৮ বছর বয়সী তাজুলকে দাফন করা হয় বলে জানান তার ছেলে।
তাজুলের মৃত্যুর ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও তার পরিবারের সদস্যদের কান্না আর আহাজারি এখনও থামছে না।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাজুল বরুড়া উপজেলার উত্তর শিলমুড়ি ইউনিয়নের গামারোয়া গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান নিয়ে ঢাকার পূর্বাচল এলাকার কাঞ্চনব্রিজ সংলগ্ন উলুখোলা এলাকায় থাকতেন।
এক সময় গাড়ি চালিয়ে সংসারের খরচ মেটানো তাজুল বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় জর্জরিত হওয়ার পর কর্মক্ষমতা হারিয়েছিলেন। তাই একজন চালক রেখে গাড়িটি ভাড়ায় দিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাতেন তিনি। সারাদিন তার কাটতো রেন্ট-এ কারের অফিসেই।
অর্থ সংকটের কারণে তাজুলের ছেলে-মেয়েদের কেউই এসএসসির গণ্ডি পেরোতে পারেনি। একমাত্র ছেলে সিয়াম সংসারের হাল ধরতে জামাকাপড় সেলাইয়ের কাজ শিখছেন।
কিশোর বয়সে বাবাকে হারিয়ে দিশেহারা সিয়াম বলছিল, “ঘটনার দিন বাবা আশুরার রোজা রেখেছিলেন। সেদিন ঢাকা শহরে গোলাগুলির খবর শুনে বাবাকে আমরা রাস্তায় বের হতে নিষেধ করেছিলাম। তারপরও একটি জরুরি কাজে বেরিয়েছিলেন। এরপর বাবা দুপুরে ফোন করে জানান যে, উত্তরার একটি মসজিদের ভেতর আছেন।
“গণ্ডগোলের কারণে চালককেও গাড়ি রাস্তায় বের করতে দেননি বলেও জানিয়েছিলেন। বিকালে ইফতারি নিয়ে বাসায় ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু আর ফেরা হয়নি।”
কান্নাজড়িত গলায় সিয়াম বলে, “কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে রাস্তায় উঁকি মারতেই বাবা গুলিবিদ্ধ হন। মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে তার গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পাই। হাসপাতালে রক্তাক্ত অনেক মানুষের চিৎকার আর আহাজারিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এ বয়সে এতো রক্ত কখনো দেখিনি।
“আমার বাবার তো কোনো অপরাধ ছিল না। এখন কীভাবে চলবে আমাদের সংসার? সঞ্চয় বলতে কিছুই নাই। কার কাছে বিচার চাইব। বাবার মৃত্যুর শোকে মা এখন অসুস্থ্ হয়ে পড়েছে।”
তাজুলের ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমি ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাই। ঘটনার দিন নারায়ণগঞ্জে ছিলাম। অন্য চালকদের কাছে খবর পেয়ে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে গিয়ে ভাইয়ের মরদেহ শনাক্ত করি।”
ভাইকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে রফিকুলের। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “অন্যদের কাছে জেনেছি, আমার ভাই বাসায় ফিরতে চেয়েছিলেন, তাই রাস্তার পরিস্থিতি দেখতে বের হন।
“এ সময় হঠাৎ গুলি এসে বুকে লাগে। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।”
তিনি বলেন, “ভাই মারা যাওয়ার কারণে চিকিৎকরা মরদেহের ভেতর থেকে আর গুলি বের করেননি। এ অবস্থায়ই গ্রামের বাড়িতে নিয়ে তাকে দাফন করা হয়। ভাইয়ের মৃত্যুতে তার সংসারটি অসহায় হয়ে গেল। সরকারি কোন সহায়তা না পেলে এ সংসারটি রাস্তায় বসতে হবে।”
আরও পড়ুন:
'কতই না কষ্ট প্যায়ে আমার কলিজার টুকরা মারা গেছে'
নিস্তব্ধ রুদ্রদের বাড়ি, নির্বাক বাবা-মা
'বাবা, তোমার মনের আশা পূরণ করতে পারলাম না, মাফ করে দিও'
'আর কোনো বাবা-মায়ের কোল যেন এভাবে খালি না হয়
'তিন শিশুকে নিয়ে আমি কোথায় দাঁড়াব, এখন কে ওদের দেখবে?'
কোটা: সাঈদের পরিবারকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সহায়তা
কোটা: 'ও ভাইও হামাক এনা বোন কয়া ডাকো রে', সাঈদের বোনের আহাজারি
নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট কার্যালয়: 'ডাকাতি হইলেও তো এমন হয় না'
'লাঠি ফেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সেলফি', তারপরই হামলা, সিঙ্গাপুরে কেম