মায়ের শাড়িতে মায়ের কবরে শায়িত সিরাজুল আলম খান

এর আগে তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানান রাজনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

নোয়াখালী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2023, 06:48 PM
Updated : 10 June 2023, 06:48 PM

বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের ইচ্ছা অনুযায়ী মায়ের শাড়িতে মুড়িয়ে তাকে সমাহিত করা হয়েছে মায়ের কবরেই।

শনিবার সন্ধ্যায় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের কবরে ‘দাদা ভাই’কে শায়িত করা হয়।

এর আগে এদিন সকাল পৌনে ৯টায় তার কফিন ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে আনার পর সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সকাল ১০টায় জানাজা হয়। এরপর প্রয়াত নেতার কফিন অ্যাম্বুলেন্সে করে রওনা হয় তার জন্মস্থান নোয়াখালীর উদ্দেশে।

Also Read: রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খানের মৃত্যু

দুপুরের দিকে নোয়াখালীর পৈত্রিক ভিটায় সিরাজুল আলমের মরদেহ আনা হলে সেখানে শ্রদ্ধা জানান জাসদ, জেএসডি, আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। পরে বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। 

জানাজার আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আলম খানকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, জাসদের সহ সভাপতি নুরুল আখতার, নোয়াখালী ৩ আসনের সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদ কিরণ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম, নোয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম হায়দার, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান, জেলা জাসদের সাবেক সভাপতি নূর আলম চৌধুরী পারভেজ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজিজুল হক।

নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার বেলা আড়াইটায় সিরাজুল আলম খানের মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রামণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।

সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। সরকারি চাকুরে বাবা খোরশেদ আলমের বদলিজনিত কারণে তাকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পড়াশোনা করতে হয়।

১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন গণিতে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়।

সিরাজুল আলম খান কখনও জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।

Also Read: ‘গুরু’ সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত আ স ম রব

তিনি কখনও নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন।

দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে আসা চিরকুমার সিরাজুল আলম খান ঢাকার কলাবাগানে ভাইদের সঙ্গেই থাকতেন।

তার জীবনাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার

সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক শিষ্য ও অনুরাগীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শোষণহীন, বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তার জীবনাদর্শ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

প্রয়াত ‘দাদা ভাই’য়ের গ্রামের বাড়ি আলীপুরে তার দাফন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসে তারা এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং এর আগে পরে সিরাজুল আলম খানের অনন্য সাধারণ ভূমিকা, তার ত্যাগ ও নির্মোহ জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন।

তার শিষ্য জেএসডি সভাপতি আসম আব্দুর রব বলেন, "সিরাজুল আলম খান আমৃত্যু দেশ, জাতি ও মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন। তিনি এদেশের এবং গোটা বিশ্বের অধিকার হারা মানুষের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন।

“তার ব্যক্তিগত জীবন, ব্যক্তিগত সম্পদ বলে কোনো কিছু ছিল না। এ দেশ, এ জাতি যতদিন থাকবে ততদিন সিরাজুল আলম খান মানুষের হৃদয়ে চীর ভাস্বর হয়ে থাকবেন। তাকে ইতিহাস থেকে কেউ মুছে ফলতে পারবে না।"

বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, “সিরাজুল আলম খান ইতিহাসের এক বিরল ব্যক্তিত্ব। মানুষ যখন ক্ষমতার জন্য পাগল, সেই সময় তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে জনতার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। আমার বিশ্বাস সিরাজুল আলম খানের আদর্শ অমর থাকবে। উনি জনগণের মধ্যে অমর থাকবেন।”

জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটির সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শফি উদ্দিন মোল্লা বলেন, “সিরাজুল আলম খানন যতদিন বেঁচে ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল সাধারণ জীবন যাপন করেছেন এবং সাধারণ মানুষের চিন্তাই করেছেন। এদেশের মানুষের মুক্তির চিন্তাই করেছেন।

“আমরা তার দর্শন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাব।”

Also Read: সিরাজুল আলম খানের শেষ শ্রদ্ধায় খেদ, প্রাপ্য সম্মান পাননি তিনি

জাসদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জিয়াউল হক মুক্তা বলেন, “সিরাজুল আলম খান যে দেশটা তৈরি করেছেন এটাই হচ্ছে তার আদর্শ। সেটা প্রতিষ্ঠার দিকে আমাদেকে এগিয়ে যেতে হবে।”

সিরাজুল আলম খানের ছোট ভাই ফেরদৌস আলম খান বলেন, “আমাদের কোনো দুঃখ নেই। বরং আমরা আনন্দিত, গর্বিত যে সিরাজুল আলম খানের পরিবারে আমরা জন্মেছি। উনি কোনদিন কারও কাছে কিছু চান নাই। উনি সব সময় নিভৃত্তে রাজনীতি করতেন। ‘৬২ সালে নিউক্লিয়াস গঠন করে উনি প্রথম স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। তারই রেশ ধরে আজকে আমরা স্বাধীনতা পতাকা উড়াচ্ছি।

“উনার যে স্বপ্ন, যে কাজগুলো বাকি আছে সেগুলো যেন বাস্তবায়ন করা যায় সেজন্য আমরা সবার সহযোগীতা চাই।”