জাসদসহ বিভিন্ন বাম দলের সঙ্গে বিএনপি নেতারাও অংশ নেন রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’র শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনে।
Published : 10 Jun 2023, 02:32 PM
বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খানের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ রাজনীতির অঙ্গনে ছড়িয়ে থাকা তার ভক্তরা।
শনিবার ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জানাজার আগে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এতে জাসদসহ বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপি নেতারাও অংশ নেন।
গত শতকের ষাটের দশকে আওয়ামী লীগে যুক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ভেঙে জাসদ গড়ার কারিগর ছিলেন।
নেপথ্যে থাকা এই ব্যক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে দেখা হয়।
দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগতে থাকা সিরাজুল আলম খান ৮২ বছর বয়সে শুক্রবার মারা যান।
শনিবার সকাল পৌনে ৯টায় তার কফিন বায়তুল মোকাররম মসজিদে আনার পর সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা লাইন ধরে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
জাসদ-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, বরকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সকাল ১০টায় জানাজা হয়। এরপর প্রয়াত নেতার কফিন অ্যাম্বুলেন্সে করে রওনা হয় তার জন্মস্থান নোয়াখালীর উদ্দেশে।
সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক শিষ্য আ স ম রব বলেন, “তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী উনার মরদেহ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিয়ে সমাহিত করতে আমরা যাত্রা করবে এখনই। ”
সিরাজুল আলম খানের ইচ্ছা অনুযায়ী মায়ের শাড়িতে মুড়িয়ে তাকে সমাহিত করা হয়েছে মায়ের কবরেই। শনিবার সন্ধ্যায় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের কবরে তাকে শায়িত করা হয়।
সেখানে জানাজায় আ স ম আবদুর রব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, নোয়াখালী-৩ আসনের এমপি মামুনুর রশিদ কিরণসহ বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী অংশ নেন।
জাসদের বিভিন্ন অংশের নেতারা একসঙ্গে
জাসদ প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর ছিলেন সিরাজুল আলম খান; দলটির রাজনৈতিক দর্শন ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ তারই চয়ন। সেই জাসদ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে নেতারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেলেও তাদের ‘দাদা ভাই’র মৃত্যুতে তারা সবাই এক হয়েছিলেন।
জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, জাসদের (ইনু) শিরিন আখতার, বাংলাদেশ জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া, নাজমুল হক প্রধান ছিলেন জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদনে।
সিরাজুল আলম খানের আত্মীয় ফরহাদ মজহার, শওকত মাহমুদ, হামীম গ্রুপের কর্ণধার এ কে আজাদ, কবি মোহন রায়হানসহ সাবেক অনেক সচিব, ব্যবসায়ী ছিলেন জানাজায়।
পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা।
ডাকসুর সাবেক সভাপতি রব নিজের রাজনৈতিক গুরুর স্মরণে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামে একটা দেশ হবে, ১৯৬২ সালে এটা যখন কেউ চিন্তা করেনি, তখন তিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নিউক্লিয়াস গঠন করেছেন। আজকে এভাবে নিভৃতে আমাদের থেকে বিদায় নেবেন এটা ভাবতে কান্না আসে।
“সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা এই জানাজায় আছেন, দলমত নির্বিশেষে। ব্যক্তিগত জীবনে উনার কোনো লোভ-লালসা ছিল না। সিরাজুল আলম খান ব্যক্তি-পরিবারের সম্পত্তি নয়, সিরাজুল আলম খান দলের সম্পত্তি নয়, সিরাজুল আলম খান ১৮ কোটির মানুষের সম্পত্তি।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “৬০ এর দশকে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঠিত হচ্ছিল, সেই সময়ে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন সিরাজুল আলম খান সাহেব। সবসময় রাজনীতির পেছনে থেকে রাজনীতিকে তিনি পরিচালনা করেছেন, অসাধারণ একজন সংগঠক ছিলেন।”
“আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় হলেও আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন তাকে দেখেছি ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল তেঁতুলিয়ায় মুক্ত এলাকা ছিল সেখানে। পরবর্তীকালে আবারও কয়েকবার আমার দেখা হয়েছে। যেহেতু আমাদের রাজনীতি ভিন্ন ছিল, সেজন্য রাজনৈতিকভাবে কখনও তাকে সেইভাবে কাছে না পেলেও আমি তাকে গভীর শ্রদ্ধা করি।”
যথাযথ সম্মান পাননি, খেদ সহকর্মীদের
সিরাজুল আলমের রাজনৈতিক সহকর্মীরা মনে করেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক হিসেবে প্রাপ্য সম্মান পাননি তিনি।
ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “সিরাজুল আলম খানের অবদান আইয়ুব সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম-সেটি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি ও পটভূমি রচনায় তার যে অবদান, সেটা জাতির ইতিহাসে চিরদিন অক্ষয় হয়ে থাকবে।
“পরবর্তীকালে রাজনৈতিক মতপার্থক্য হয়েছে, কিন্তু তার এই অবদান সেটা জাতি যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বীকৃতি দিল না… আমি মনে করি এটা একটা অপরাধ, জাতির পক্ষ থেকে একটা অপরাধ করা হল।”
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে জাতির এই সূর্য সন্তানকে জাতির পক্ষ থেকে, জনগণের পক্ষ থেকে যে সম্মান জানানো উচিৎ ছিল, আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার সেই সম্মান তাকে জানাতে পারেনি।
“সিরাজুল আলম খানের এই প্রয়াণে আজকে জাতীয় শোক দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া উচিৎ ছিল। বাংলাদেশে ও সিরাজুল আলম খান এক এবং অবিচ্ছেদ্য। দেশের স্বার্থের বাইরে তার নিজের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ ছিল না।”
ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “সিরাজুল আলম খানকে সম্মান জানালে রাষ্ট্র ছোট হত না, রাষ্ট্রের কোনো ক্ষয় হত না।
“আজকে দেখেন, জানাজাতে সরকারি দলের একজন মানুষও নাই। অথচ সরকারি দলের বাঘা বাঘা কয়েকজন নেতার নাম বলা যাবে এখন জীবিত, তাদের বয়স বেশি হয়েছে বটে তবে আসতে পারতেন এই জানাজায়।”
জাসদের এক সময়ের নেতা মান্না বলেন, “ইতিহাস বলবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে উনার যে অবদান, এগুলো অস্বীকার করা যাবে না। সত্যি কথা হচ্ছে, সিরাজুল আলম খান না থাকলে এই স্বাধীনতা কীভাবে বিকশিত হত, কীভাবে আসত এটা নিয়ে অনেক গবেষণার ব্যাপার আছে। তাকে সম্মান না দিয়ে ছোট হয়েছে সরকার, তাদের সংকীর্ণ মন-মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে।”
গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি বলেন, “তার বিশিষ্ট ভূমিকাকে রাষ্ট্রের যেভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দরকার ছিল, রাষ্ট্র সেটা দেয়নি। এটা রাষ্ট্রের দুর্বলতা বলে আমি মনে করি।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, “বাংলাদেশে তার মতো একজন কিংবদন্তি রাজনীতিক যথাযোগ্য মর্যাদা হয়ত পাননি এই কারণেই যে, তিনি স্বাধীনতার পরেই বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।”