‘গুরু’ সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত আ স ম রব

সিরাজুল আলম খান কখনও জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2023, 12:35 PM
Updated : 9 June 2023, 12:35 PM

‘তার প্রস্থান, তার এই চলে যাওয়া… আমি এখন কিছুই বলতে পারছি না, মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না, একটা কথাও বলার শক্তি পাচ্ছি না।’

সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে এভাবেই নিজেই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন আ স ম আবদুর রব, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিলেন ডাকসুর ভিপি, ছিলেন ‘দাদা ভাইয়ের’ খুব কাছাকাছি।

সিরাজুল আলম খানকে নিজের ‘রাজনৈতিক দার্শনিক শিক্ষক’ হিসেবে বর্ণনা করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি রব এক বিবৃতিতে বলেন, “তিনি চলে গেলেও ইতিহাস তাকে বাঙালির দেদীপ্যমান ‘বাতিঘর’ হিসেবে ইতিহাসের ঐতিহাসিকতায় ধারণ করবে।”

শুক্রবার বেলা আড়াইটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান সিরাজুল আলম খান। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

মৃত্যু সংবাদের পর যোগাযোগ করা হলে রব বলেন, “আমি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছি। কথা বলতে পারছি না।”

তবে ই মেইলের মাধ্যমে একটি শোক বার্তা পাঠিয়েছেন রব, সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকার কথা তিনি স্মরণ করেছেন।

‘সিরাজুল আলম খান চিরঞ্জীব থাকবেন’ মন্তব্য করে সেখানে বলা হয়, “তার মৃত্যুতে দেশ অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাল। তিনি বাঙালির অন্তরাত্মায় সদা সর্বদা সার্বাগ্রে জাগ্রত থাকবেন।”

বিবৃতিতে সিরাজুল আলম খানকে ‘স্বাধীনতার প্রাণ পুরুষ, নেপথ্যের নায়ক ও সফল স্বপ্ন দ্রষ্টা’ হিসেবে তুল ধরেছেন রব। তিনি বলেছেন,

“বাঙালির জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যুব ছাত্রদের মনে স্বাধীনতার অগ্নিশিখা ছড়িয়ে দেওয়ার মন্ত্র এবং সকল সংগ্রাম আন্দোলনকে গণআন্দোলনে রূপান্তর করে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার অন্যতম কৌশল প্রণয়নকারী তিনি। ১৯৬২ সালেই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস গঠন করেন। এই নিউক্লিয়াসই ছাত্র জনতার আন্দোলন, ৬ দফা ১১ দফাসহ প্রতিটি আন্দোলনকে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির কাজে রূপ দিতে গুরু দায়িত্ব পালন করে।

“একাত্তরের পূর্বেই সম্ভাব্য সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধকে হিসেবে রেখে, বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। জয়বাংলা বাহিনী গঠন, জাতীয় পতাকা তৈরি ও উত্তোলন, জাতীয় সংগীত নির্ধারণ, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে স্বাধীনতার ইশতেহার প্রণয়ন, অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চের ভাষণসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সাথে সমন্বয় সাধনে ঐতিহাসিক ও যুগান্তরকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে অনন্য ইতিহাসের নায়ক তিনি।” 

স্বাধীন বাংলাদেশে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকার বর্ণনা দিয়ে আ স ম রবের বিবৃতিতে বলা হয়, “সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের পর 'বিপ্লবী জাতীয় সরকার' গঠন, স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় সংবিধান প্রণয়ন, জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর গঠন এবং সমবায়ভিত্তিক অর্থনীতিসহ ১৫ দফা করণীয় উত্থাপন করে রাষ্ট্র বিনির্মাণের রূপরেখা প্রদান করেন। ১৯৭২ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন, ৭৫ এ সিপাহী জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল খান। বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে অনেক অবিস্মরণীয় ঘটনার নেপথ্য নায়ক তিনি।

“পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী সামাজিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে ১৪ দফা সম্মিলিত সম্মিলিত রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক মডেলসহ রাজনৈতিক তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন।” 

রব লিখেছেন, “ব্যক্তিগত সম্পদ-স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনের বাইরে অকৃতদার সিরাজুল আলম খান অনন্য সাধারণ বাঙালি।”

‘রহস্য পুরুষ’

সিরাজুল আলম খান রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবেই পরিচিত।

ষাটের দশকে ছাত্রলীগ করার সময় তিনি ছাড়াও আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়।

তিনি কখনও নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন।

সিরাজুল আলম খান কখনও জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।

দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে আসা চিরকুমার সিরাজুল আলম খান ঢাকার কলাবাগানে ভাইদের সঙ্গেই থাকতেন।

গত ৭ মে থেকে শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার। পরে ২০ মে তাকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়।

শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ জুন তাকে কেবিন থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে হার্ট অ্যাটাক করার এক ঘণ্টা পর মারা যান তিনি।