দুই দিন ধরে ধারাবাহিক সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ওসিসহ অন্তত ১০ পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্য ও অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী।
Published : 14 Apr 2025, 05:24 PM
ঈদের সময় বাজি ফাটানোয় জের ধরে মাদারীপুরের রাজৈরে দুই গ্রামের মধ্যে দফায় দফায় চলা সংঘর্ষ ঠেকাতে তিনটি গ্রাম ও সংলগ্ন বাজার এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে উপজেলা প্রশাসন।
উপজেলার পশ্চিম রাজৈর ও বদরপাশা গ্রামের মধ্যে প্রায় ১১ দিন ধরে চলা উত্তেজনার পর শনিবার রাত থেকে শুরু হয় সংঘর্ষ। দুই দিন ধরে ধারাবাহিক সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ওসিসহ অন্তত ১০ পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্য এবং দুই গামের অর্ধশতাধিক মানুষ।
পরে সোমবার দুপুর থেকে পশ্চিম রাজৈর, বদরপাশা ও গোপালগঞ্জ গ্রাম এবং সংলগ্ন রাজৈর বাজারে ১৪৪ ধারা জারি করেন রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহফুজুল হক।
তার স্বাক্ষরিত আদেশ নামায় বলা হয়, “প্রায় ৭ দিন যাবত রাজৈর বাজার সংলগ্ন পশ্চিম রাজৈর ও বদরপাশা গ্রামের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিয়মিত বিরতিতে দেশীয় অস্ত্রসহ মারামারি, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও অস্ত্র প্রদর্শনী বিভিন্ন দাঙ্গা হাঙ্গামা চলছে।
এ সকল আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারী এবং শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনে ফৌজদারী কার্যবিধি মতে ১৪৪ ধারা জারি করা হল। সোমবার দুপুর ১টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা এ আদেশ বহাল থাকবে।
আদেশে রাজৈর বাজার, পশ্চিম রাজৈর, বদরপাশা এবং গোপালগঞ্জ গ্রামে এক বা একাধিক ব্যক্তি চলাফেরা, সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মাইকের ব্যবহার, লাঠিসোঁটা বা যেকোনো প্রকারের আগ্নেয়াস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তবে দায়িত্ব পালনরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জরুরি সেবা প্রদানে নিয়োজিতদের ক্ষেত্রে এ আদেশ শিথিল থাকবে বলে লিখিত আদেশে জানানো হয়।
এ ব্যাপারে রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহফুজুল হক বলেন, “যেকোনো সময় আবার দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার আশংকা রয়েছে। এজন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কেউ লঙ্ঘন করার চেষ্টা করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, ঈদ পরবর্তী সময় গত ২ এপ্রিল পশ্চিম রাজৈর গ্রামের ফুচকা ব্রিজ এলাকায় বাজি ফাটায় বদরপাশা গ্রামের আতিয়ার আকনের ছেলে জুনায়েদ আকন ও তার বন্ধুরা।
এসময় তাদের বাধা দেয় পশ্চিম রাজৈর গ্রামের মোয়াজ্জেম খানের ছেলে জোবায়ের খান ও তার বন্ধুরা। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
এরই জের ধরে পরদিন সকালে রাজৈর বেপারিপাড়া মোড়ে জোবায়েরকে একা পেয়ে পিটিয়ে তার পা ভেঙে দেয় জুনায়েদ ও তার লোকজন।
এ ঘটনায় জোবায়েরের বড় ভাই অনিক খান (৩১) বাদি হয়ে জুনায়েদকে প্রধান করে ছয় জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনকে আসামি করে রাজৈর থানায় মামলা করেন।
এসব ঘটনায় উভয় গ্রামের লোকজনই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। ধারাবাহিকভাবে চলা উত্তেজনার একপর্যায়ে শনিবার রাতে পশ্চিম রাজৈর ও বদরপাশার লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
কয়েকঘণ্টা ব্যাপি এ সংঘর্ষে ব্যাপক ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে রাজৈর থানার পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে ঘণ্টাব্যাপী প্রচেষ্টা চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পরে রোববার দুপুরে বদরপাশা ও পশ্চিম রাজৈর গ্রামের দুই পক্ষের লোকজনকে ডেকে মীমাংসার জন্য রাজি করান রাজৈর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ওহাব আলী মিয়াসহ স্থানীয় গণ্যমান্যরা। সোমবার সকাল ১০টার সময় শালিস-মীমাংসার জন্য বসার কথা ছিল।
এরই মধ্যে রোববার সন্ধ্যায় উভয় পক্ষের লোকজনের উস্কানিমূলক কথাবার্তায় উত্তেজিত হয়ে আবারও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। এ সময় বদরপাশা গ্রামের লোকজন বেশ কয়েকটি হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ও দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তারা ১২টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করে বলেও অভিযোগ উঠে।
একপর্যায়ে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এরপর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে রাজৈর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। ঘটনাস্থলে র্যাব মোতায়েন করা হয়।
দ্বিতীয় দিনের এ ঘটনায় মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম, রাজৈর থানার ওসি মো. মাসুদ খান ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের অর্ধশত লোকজন আহত হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমের পায়ে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে অপারেশন করা হয়। বাকি আহতরা রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন।
আহতদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় পশ্চিম রাজৈর গ্রামের মেহেদী মীর (২২), রাসেল শেখ (২৮), সাহাপাড়ার মনোতোষ সাহা (৫০), আলমদস্তারের তাওফিককে (৩৭) রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।
এর মধ্যে রাত সাড়ে ১১টার সময় চতুর্থ ধাপের সংঘর্ষ শেষে রাজৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সভা করছিল পশ্চিম রাজৈরের পক্ষ নেওয়া মজুমদার কান্দি গ্রামের লোকজন।
খবর পেয়ে রাজৈর থানার পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের দুটি গাড়িতে ইট-পাটকেল নিয়ে হামলা চালিয়ে ব্যপক ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ঘটনায় রাজৈর থানার এসআই মোস্তফা ও পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার শাহাবুদ্দিনের মাথা ফেটে গুরুতর আহত হয়। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এ ঘটনার পর এলাকায় পুলিশ ও সেনা সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত আছে বলে জানান রাজৈর থানার ওসি মো. মাসুদ খান।