স্থায়ীভাবে ইতালি যাওয়ার আগে মোবারক তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে একসঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের একটি রেস্তোরাঁয়।
Published : 01 Mar 2024, 06:01 PM
কথা ছিল, পরিবার নিয়ে ইতালি চলে যাওয়ার আগে শুক্রবার মাকে দেখতে গ্রামের বাড়ি যাবেন ছেলে। সেজন্য ছেলের পছন্দের খাবারের বাজার-সদাই করিয়ে রেখেছিলেন বৃদ্ধ মা। রাত পোহালেই বাড়িটির সদস্যদের আনন্দে মেতে উঠার আয়োজন ছিল; সেখানে আজ মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে প্রতিবেশীদেরও চোখের জল আটকে রাখা কঠিন হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে নিহত ৪৬ জনের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের শাহবাজপুর গ্রামের একই পরিবারের পাঁচজন রয়েছেন।
তারা হলেন- শাহবাজপুর গ্রামের মৃত সৈয়দ কাশেম মিয়া ও সৈয়দা হেলেনা বেগম দম্পতির ছেলে ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন (৪৮), তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম (৩৫), তাদের দুই মেয়ে সৈয়দা কাশফিয়া (১৭) ও সৈয়দা নূর (১২) এবং ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ (৭)।
পরিবার জানিয়েছে, দেশ ছাড়ার আগে মোবারক স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন গ্রিন কোজি কটেজে বিরিয়ানির দোকান কাচ্চি ভাইয়ের শাখায়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেখানেই যাওয়াই কাল হল মোবারক হোসেনের। পরিবারের পাঁচজনের সবাই এখন লাশ।
শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিবারের পাঁচজনের লাশ বুঝে নেন মোবারকের দুলাভাই সৈয়দ গাউসুল আজম। বেলা সোয়া ৩টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে পাঁচটি মরদেহ পৌঁছায় শাহবাজপুরের গ্রামের বাড়িতে।
সৈয়দ বাড়ির বাইরে সারিবদ্ধভাবে রাখা পাঁচটি খাটিয়ায় রাখা হয় পাঁচজনের মরদেহ। এ সময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ মা সৈয়দা হেলেনা বেগমের ঘর থেকে ছেলের নাম ধরে ডুকরে কাঁদছিলেন। কিছুক্ষণ পরপরই সংজ্ঞা হারাচ্ছেন তিনি।
যারা মোবারকের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন তাদের চোখও ছিল ভেজা। শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে গোটা গ্রামটাই। বাড়ির পাশেই সৈয়দ কাশেম মিয়ার কবরের সঙ্গে পাশাপাশি খোঁড়া হয়েছে পাঁচটি কবর। আসর নামাজের পর জানাজা শেষে তাদের সেখানে শায়িত করা হয়।
নিহত মোবারকের চাচা আব্দুল কাইয়ূম সাংবাদিকদের বলেন, “চার ভাই-বোনের মধ্যে মোবারক দ্বিতীয়। ১০-১২ বছর আগে ইতালি পাড়ি জমায়। সম্প্রতি ইতালিতে স্থায়ী বসবাসের অনুমোদন পান তিনি। তাই স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়েকে ইতালি নিয়ে যেতে গত ১ মাস আগে দেশে আসেন মোবারক। পরিবারের সবারই ভিসা হয়েছে ইতালির। ১০ মার্চ তাদের ফ্লাইট ছিল।
“মোবারকের পরিবার কয়েক বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করছিলেন। তারা মগবাজারের মধুবাগে থাকতেন। শুক্রবার পরিবার নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা ছিল মোবারক হোসেনের। ভাল-মন্দ বাজার সদাই করা হয়েছিল।”
আব্দুল কাইয়ূম বলেন, “ইতালি যাওয়ার আগে সন্তানদের ইচ্ছাপূরণে বৃহস্পতিবার রাতের খাবার খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন পরিবারের সবাই। সেখানেই অগ্নিকাণ্ডে সবাই মারা যায়।”
মোবারকের প্রতিবেশী আবদুস সালাম বলেন, “এমন একটি সংবাদের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। একটা পরিবারের একটা না, দুইটা না, পাঁচটা তাজা প্রাণ ঝরে গেল। এটা কল্পনাও করতে পারি না। এ রকম একটা হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্য আমাদের গ্রামের কেউ প্রস্তুত ছিল না। যেই শুনতেছে তারাই আহাজারি করতেছে। এ রকম ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সে ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।”
পাশের খন্দকার পাড়ার বাসিন্দা সেকেন্দার মিয়া বলেন, “এ খবর গ্রামে আসার পর অনেকের বাড়িঘরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই শোকে বিহ্বল।”
পাশের গ্রাম থেকে আসা নিসার উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, “শুনেছি আজকেই তাদের বাড়ি আসার কথা ছিল। আসলো ঠিকই, নিথর দেহে লাশ হয়ে। মোবারকের সত্তর বছরের মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত আমাদের কারো ভাষা নেই।”
আরও পড়ুন:
সন্তানদের ‘জড়িয়ে ধরে’ লাশ হলেন পপি
ট্রাক ভর্তি লাশ, কান্নায় ভারি ঢাকা মেডিকেল
বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুনে অন্তত ৪৪ মৃত্যু
গ্রিন কোজি কটেজে আগুন চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে: ফায়ার সার্ভিস