মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য বিভিন্নজনের কাছ থেকে স্ত্রী টাকাও নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন আলামিন।
Published : 14 Nov 2024, 12:01 AM
সাভার প্রতিনিধি. বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম.বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাভারের আশুলিয়ায় স্বামীকে ‘নিহত দেখিয়ে’ দায়ের করা মামলার বাদীকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।
এদিকে যাকে মৃত দেখিয়ে এই মামলা করা হয়েছে সেই আলামিন মিয়া (৩৪) বুধবার ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির হয়ে মামলার সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার এসআই রকিবুল হোসেন জানান।
পুলিশ জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আশুলিয়া থানা এলাকায় একাধিক নিহতের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে গুলিতে নিহত একজনের পরিচয় ছিল অজ্ঞাত। সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিকেই নিজের স্বামী দাবি করে হত্যা মামলা করেন আলামিনের স্ত্রী কুলসুম বেগম (২১)।
সরকার পতনের পর ২৪ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মামলাটি করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে ৮ নভেম্বর আশুলিয়া থানায় মামলাটি (নং-২১) নথিভুক্ত হয়।
মামলায় মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর থেকে কুলসুম বেগম আত্মগোপনে চলে যান। তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।
স্বামী আলামিন মিয়া মামলার কপি হাতে পেয়ে অবাক হয়ে যান। তিনি ভয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। অবশেষে সোমবার তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় হাজির হয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। পরে দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি আবুল হোসেন আশুলিয়া থানাকে বিষয়টি অবহিত করেন।
তখন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার এসআই রকিবুল হোসেন দক্ষিণ সুরমা থানায় গিয়ে আলামিনকে মঙ্গলবার রাতে আশুলিয়া থানায় নিয়ে আসেন।
আলামিন মিয়ার জবানবন্দির ব্যাপারে জানতে চাইলে এসআই রকিবুল হোসেন বুধবার রাতে বলেন, “আলামিনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ তুলে তার স্ত্রী কুলসুম যে মামলাটি করেছে তা মিথ্যা। আলামিন মারা যায়নি। বুধবার দুপুরে আদালতে ১৬৪ ধারায় তিনি জবানবন্দি দিয়েছেন।”
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “আলামিনকে মামলার সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির করিয়ে আমি চলে এসেছি। আলামিনের সঙ্গে তার বাবা নুরুল ইসলাম ছিলেন।”
মামলার বাদীকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা তদন্তের স্বার্থে আর কিছু বলতে রাজী হননি।
বাদী কুলসুম বেগম মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার স্বল্পসিংজুরী বাংগালা গ্রামের আব্দুল খালেকের মেয়ে। তিনি আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার রুহুল আমিনের বাড়ির ভাড়াটিয়া। কিন্তু কোনো ঠিকানাতে গিয়েও তার হদিস পায়নি পুলিশ। এমনকি এজাহারে তিনি যে মোবাইল নম্বর দিয়েছেন সেটিও বন্ধ রয়েছে।
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন বলেন, বাদী ওই নারী মিথ্যা মামলা করেছেন। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আটকের পর তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এখন আদালত যে নির্দেশনা দেবেন সেভাবেই কাজ করা হবে বলে আশুলিয়া থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানিয়েছেন।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীনুল কবীর বলেন, “মামলার বাদী কুলসুম কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলাটি করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ৫ অগাস্ট সকাল সাড়ে ৯টায় আলামিন মিয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকাল ৪টার দিকে তিনি আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিলে অংশ নেয়। তবে পরাজয় মেনে না নিতে পেরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচার গুলি ছুড়ে ও লাঠিপেটা করতে থাকে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আলামিন মারা যান।
মামলায় বাদী বলেছেন, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তিনি স্বামীর সন্ধান পাননি। পরে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালের ৬ অগাস্টের এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পারেন, এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা লাশ জানাজা দিয়ে দাফন করেছে। এসব ডকুমেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আছে। পরে তিনি হাসপাতালে থাকা কাগজপত্র, ছবি ও ভিডিও দেখে স্বামীর লাশ শনাক্ত করে থানায় মামলা করতে যান। থানা থেকে তাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তখন তিনি আদালতে মামলাটি করেন।
মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুছ ছালাম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, আশুলিয়া থানার সাবেক ওসি এ এফ এম সায়েদ, আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মোখলেসুর রহমান ওরফে ইলিয়াস শাহী, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়।
আলামিন মিয়া বলেন, “মোবাইলে পরিচয়ের সূত্র ধরে ভালবেসে বিয়ে করি কুলসুমকে। আমাদের একটি কন্যসন্তানও রয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে পারিবারিক কলহ বেড়ে যাওয়ায় সময়টা ভাল যাচ্ছিলো না।
“আন্দোলনের পুরোটা সময় আমি ও আমার স্ত্রী মৌলভীবাজারের জুড়িতে অবস্থান করেছি। সে সময় আশুলিয়াতে একবারের জন্যও আসিনি। অথচ আমাকে মৃত দেখিয়ে মিথ্যা মামলা করেছেন আমার স্ত্রী।”
মামলা থেকে নাম কাটানোর কথা বলে কুলসুম বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন আলামিন মিয়া।
আলামিনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, “কয়েকদিন আগে ভাই আমাকে বলেছে মামলার বিষয়টি। কী করবে বুঝতে না পেরে সে ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে।”
এদিকে জীবিত ছেলেকে মৃত দেখিয়ে মামলার ঘটনায় হতবাক আলামিনের বাবা নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “এমনটা হওয়ায় আলামিনসহ আমাদের পুরো পরিবার এখন আতঙ্কগ্রস্ত। ছেলের বউ এমনটি কেন করেছে তা মাথায়ও আসছে না।”