ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে পাউবো জানিয়েছে।
Published : 23 Aug 2024, 05:12 PM
ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কুমিল্লা গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে গোটা বুড়িচং উপজেলাই তলিয়ে গেছে। উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের পানিবন্দি মানুষ বিশুদ্ধ পানি আর খাবার সংকটের কারণে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়েছেন।
যেভাবে তীব্র বেগে পানি ঢুকছে এতে দ্রুতই পাশের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এই অবস্থায় পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাশাপাশি কাজ শুরু করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান শুক্রবার বেলা ৩টায় বলেন, “বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে বুড়বুড়িয়া এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধের নিচ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল। স্থানীয় লোকজন বালুর বস্তা ফেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।
“রাত পৌনে ১২টার দিকে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। বাঁধের অন্তত ৩০ ফুট ভেঙে গেছে। নদীর পানি না কমলে এই বাঁধ মেরামত করা সম্ভব না। নদীর পানি যতদিন না কমবে ততদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে থাকবে।”
প্রকৌশলী বলেন, “শুক্রবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত গোমতীর পানি বিপৎসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। সে হিসেবে পানি কিছুটা কমেছে। নদীর শহর রক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, অন্য কোথাও যেন বাঁধ না ভাঙে সেদিকে লক্ষ্য রাখার।”
পাউবো কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯৭ সালে গোমতীর পানি বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। কিন্তু গত দুইদিনে পানি বাড়ার হিসাব অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বিকাল সাড়ে ৩টায় বলেন, “এখন আর গ্রাম, ইউনিয়ন হিসাব করে লাভ নেই। পুরো বুড়িচংই পানির নিচে। প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করায় প্রতিনিয়ত পানির উচ্চতা বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে আশপাশের উপজেলাও প্লাবিত হতে পারে।”
ইউএনও বলেন, “বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই স্থানীয় লোকজনকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে এলাকায় মাইকিং করা হয়। এরই মধ্যে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন। পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারকে কাজ চলছে।”
স্থানীয় প্রশাসন, সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন বলে জানান সাহিদা আক্তার।
‘গোমতীতে এত পানি আগে দেখিনি’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া গ্রামের কাছে গোমতী নদীর বাঁধটি ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। শুক্রবার দুপুর ২টার মধ্যে সারা উপজেলা গোমতীর পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়।
বাঁধ ভাঙার পর থেকেই বুড়িচং উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করে। বর্তমানে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
এই সময়ে মানুষকে উদ্ধার করাই বড় কাজ বলে মনে করেন কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বুড়িচংয়ের বুড়বুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা গোলাম কিবরিয়া।
তিনি বলেন, “আমাদের গ্রামে বর্তমানে গলা সমান পানি। পুরো গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। মানুষের দুর্ভোগ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। গোমতীতে এতো পানি আগে কখনো দেখিনি।”
উপজেলার শিমাইলখাড়া গ্রামের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা সৌরভ বলেন, “পানি হু হু করে ঢুকছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান সোনার বাংলা কলেজে আশ্রয়কেন্দ্র আছে। মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসে নিরাপদে থাকতে বলা হচ্ছে।”
উপজেলার গাজীপুর এলাকার বাসিন্দা সালমা হক বলেন, “আমাদের বাসার মালামাল ছাদের উপরে রেখেছি। পানি বাড়ছে। আমার মাকে নিয়ে কুমিল্লা শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া সড়কে পানি ওঠায় যানচলাচল বন্ধ। বলতে গেলে চরম দুর্ভোগে পড়েছি। এলাকার সব বাড়িঘর পানির নিচে।”
এদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার সঙ্কটে শিশু-বৃদ্ধসহ বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বুড়িচং উপজেলা প্লাবিত হতে শুরু করলে মানুষজন প্রাণ রক্ষায় ছুটতে থাকেন আশ্রয়কেন্দের দিকে। তবে সেখানে রয়েছে খাবার ও চিকিৎসা-সংকট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুড়িচং উপজেলার মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে সেখানে কেউই খাবার ও চিকিৎসাসেবা নিয়ে যায়নি।
যে কারণে ২০ জনের বেশি শিশু ও ১০ বৃদ্ধকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আশ্রয় গ্রহণকারীরা।
শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রশিদ আহমেদ বলেন, “খাবার না থাকার বিষয়টি আমরা আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের জানিয়েছি। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত, তারাও বিপদে আছে।”
যাদের পক্ষে সম্ভব দ্রুত ত্রাণ নিয়ে মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, “এখানকার প্রায় ৫০০ মানুষ না খেয়ে আছে। শিশুরা কান্না করছে। বের হওয়ার কোনো অবস্থা নেই। কারণ বিদ্যালয়ের নিচতলা পানিতে ডুবে গেছে।”
আতঙ্কে কুমিল্লা নগরবাসীও
এদিকে, বুড়িচংয়ে গোমতীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই আতঙ্কে ঘুম নেই কুমিল্লা নগরবাসীর। কারণ গোমতী নদীর পাড়েই অবস্থান এই নগরী। বৃহস্পতিবার প্রায় পুরো রাতই নগরীর সিংহভাগ মানুষ জেগে ছিলেন বাঁধ ভাঙার আতঙ্কে। নগরীর বাসিন্দাদের শঙ্কা, গোমতীর বাঁধ ভাঙলেই তলিয়ে যাবে গোটা শহর।
শুক্রবার নগরীর কাপ্তান বাজার এলাকার বাসিন্দা সামছুল আলম বলেন, “বুড়িচংয়ে বাঁধ ভাঙার খবর পাওয়ার পর থেকেই মানুষ আতঙ্কে আছে। কারণ, গোমতীর বাঁধ ভেঙে গেলে পানিতে তলিয়ে যাবে গোটা শহর। এমনিতে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীর সড়কগুলো তলিয়ে যায়। যদি গোমতীর বাঁধ ভেঙে যায়, তবে পুরে শহর তলিয়ে যাবে।”
জেলার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, লাকসামসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার বেশিরভাগ গ্রাম এখনো বন্যার পানিতে ডুবে আছে। তবে বৃহস্পতিবারের তুলনায় শুক্রবার এসব উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
এ ছাড়া বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম উপজেলার দুই কিলোমিটার এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়। শুক্রবার এই স্থানে মহাসড়কে পানি দেখা যায়নি।