“আমরা তো জানিনে বাঘাইড় ধরা নিষেধ। বাজারে বিক্রির সময়ও কেউ বলে নাই।”
Published : 23 Dec 2024, 10:00 AM
দেশের প্রধান তিন নদীর দুটি পদ্মা-যমুনা নদীতে অবাধে চলছে মহাবিপন্ন প্রজাতির বাঘাইড় মাছ শিকার। পদ্মা-যমুনা মিলিত হয়েছে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটের অদূরে। এই মোহনায় জেলেদের জালে প্রতিনিয়ত ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পাশাপাশি আটকা পড়ছে বাঘাইড়।
বাঘাইড় বিক্রির জন্য এরই মধ্যে দৌলতদিয়া ঘাটের মাছ ব্যবসায়ীরা সারাদেশে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এখানে ১০ থেকে ৭০ কেজি ওজনের বাঘাইড়ের সঙ্গে শিকার করা হচ্ছে বাচ্চা বাঘাইড়ও। পরে প্রকাশ্যেই চলে কেনাবেচা। বাজারে ‘ভালো দাম’ পাওয়ায় জেলেরাও আগ্রহী এই মাছ শিকারে।
তবে এই মাছ ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও তা জানেন না ব্যবসায়ী ও জেলেরা। এভাবে অবাধে বাঘাইড় শিকার অব্যাহত থাকলে মহাবিপন্ন প্রজাতির মাছটি দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাঘাইড় মাছ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর ২ নম্বর তপশিলভুক্ত একটি সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী। মহাবিপন্ন প্রজাতির এই মাছ শিকার, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন কিংবা দখল আইনত নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন অনুযায়ী, এসব অপরাধে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে।
তবে আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে বাঘাইড় শিকার ও কেনাবেচা। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে গোয়ালন্দ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা আল রাজীবের কণ্ঠে ফুটে ওঠে অসহায়ত্বের ছাপ।
তিনি বলছিলেন, “বাঘাইড় মাছ হচ্ছে মহাবিপন্ন প্রাণী। এটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২-এর তপশিলভুক্ত প্রাণী। যেখানে মাছ শিকার, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন কিংবা দখল আইনত নিষিদ্ধ রয়েছে।
“কিন্তু এটি মৎস্য সুরক্ষা আইনে কাভার করেনি। যার কারণে বাঘাইড় মাছ ধরা বা বিক্রি হলেও আমাদের কিছু করার নেই।”
বাঘাইড় মাছ বেচাকেনা নিষিদ্ধ, তারপরও কেনো শিকার করা হয় প্রশ্নে দৌলতদিয়ার জেলে মকিম হোসেন বলেন, “এ মাছ বেচাকেনা নিষিদ্ধ এটি আমরা জানি না। কেউ আমাদের কখনও বলেও নাই, কারও কাছে শুনিও নাই।
“যদি আমরা জানতাম তাহলে বাঘাইড় শিকার করতাম না। প্রশাসনের কেউও তো জানায় নাই। ধরলেও কেউ তো না করে না। প্রশাসনের কেউ নিষেধ করলে আমরা বুঝতে পারতাম এটি নিষেধ।”
মকিমের কথা শেষ হতেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জেলে শ্রীচরণ বলে ওঠেন, “আমরা তো জানিনে বাঘাইড় মাছ ধরা নিষেধ। বাজারে বিক্রির সময়ও কেউ বলে নাই এই মাছ ধরা যাবে না। প্রশাসনের লোকজনও কখনো বলে নাই। যদি প্রশাসনের কেউ বলত তাহলে ধরতাম না।”
দৌতলদিয়ার সাত নম্বর ফেরি ঘাট জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাঘাইড় মাছ সাধারণত এক-দেড় হাজার কেজি দরেও বিক্রি হয়। ৫৫ কেজি ওজনের বাঘাইড় ৭১ হাজার টাকায় বিক্রির রেকর্ড রয়েছে।
মাছের দাম নির্ধারণ কে করে এমন প্রশ্নে দৌতলদিয়ার আরেক জেলে মমিন খাঁ বলেন, “নদী থেকে মাছ মেরে আমরা আড়তে নেই। তখন আড়তদার একটা বরাদ্দ করে যে, এই মাছটা এত দাম হবার পারে। ছোট মাছের ছোট দাম, বড় মাছের বড় দাম- এর ওপরে দাম ঠিক করে। যে দাম পাই ওই দামে আমাদের মাঝে মাঝে পোষায়, মাঝে মাঝে পোষায় না। আমাদের দাম ঠিক করে দেওয়ার সুযোগ নাই। কারণ আড়তদারেরাই দাম ঠিক করে।”
বাঘাইড় মাছ ধরা বা কেনাবেচা করা যাবে না, একথা জানা নেই বলে দাবি দৌলতদিয়া মৎস্য হাটের সভাপতি মো. মোহন মণ্ডলের।
মোহন বলছিলেন, “বাঘাইড় মাছ সারাদেশেই বেচাকেনা হয়। আমি একা দৌলতদিয়ায় না বিক্রি করলে কিছু আসে যায় না। আর বাঘাইড় মাছ আমার মনে হয় বন্ধ হবে না। মাছটা খুবই স্বাদের, তেল কম যে কারণে এই মাছ ধরা ও কেনাবেচা বন্ধ হবে না।
“এই তো এই মাসের ১ তারিখে ৫২ কেজি ওজনের একটি বাঘাইড় মাছ বিক্রি হলো ৭১ হাজার টাকায়। আমি বললে কি এই মাছ বিক্রি বন্ধ হবে বলেন? আর বাঘাইড় মাছ বড়লোকেরা বেশি খায়।”
মাছ বিক্রির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দৌলতদিয়া মাছের হাটে প্রতিদিনই জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। মাছের দাম নির্ধারণ করেন ব্যাপারিরা। তারা নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকেন। আমরা আমরা আড়তদার শতকরা পাঁচ টাকা করে কমিশন পাই।”
শেখ মমিন নামে স্থানীয় এক সাংবাদিক বলছিলেন, “অবাধে পদ্মা ও যমুনা নদী থেকে জেলেরা বাঘাইড় মাছ ধরছে। পরে প্রকাশ্যেই বিক্রি করছে। বাঘাইড় ধরা নিষেধ বা বেচাকেনা নিষেধ এই বার্তাটা সংশ্লিষ্টরা জেলেদেরও নিকট পৌঁছাতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় এই মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”
দৌতলদিয়ার টার্মিনাল এলাকার মো. জুয়েল বলেন, “বাঘাইড় মাছ মহাবিপন্ন প্রাণী হলেও প্রতিদিনই পদ্মা থেকে শিকার হচ্ছে এ মাছ। এটি ধরা নিষিদ্ধ, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি দেখি নাই যে, সংশ্লিষ্টরা কোনো সময় জেলেদের নিষেধ করেছে বা জরিমানা করেছে। অবাধে মাছ শিকার করে প্রকাশ্যেই বিক্রি করছে।
“এভাবে বাঘাইড় শিকার অব্যাহত থাকলে এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই মাছ রক্ষায় প্রশাসনের নজরদারী দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”
এ প্রসঙ্গে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা আল রাজীব বলেন, “বাঘাইড় মাছ ধরা বা বিক্রির বিষয়টি মৎস্য আইনে কাভার করার দরকার ছিল। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, এটিকে মৎস্য সুরক্ষা আইনের আওতায় আনার জন্য।”
রাজবাড়ীর সহকারী বন সংরক্ষক কর্মকর্তা সানজিদা সুলতানা বলেন, “বাঘাইড় মাছ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর ২ নম্বর তপশিলভুক্ত একটি সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী । ধারা (৬) এ বলা হয়েছে, এই ধরনের কোনো প্রাণী শিকার শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
“আর ধারা (৩৯)-এ বলা হয়েছে, এই ধরনের প্রাণী যদি শিকার করা হয় তাহলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে। একই কাজ যদি কেউ আবারও করে সেক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।”
বাঘাইড় মাছ শিকার ও বেচাকেনার তাৎক্ষণিক খবর পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে আশ্বস্ত করেছেন এ বন কর্মকর্তা। পাশাপাশি এ বিষয়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে বলেও জানিয়েছেন।
এ বন কর্মকর্তা বলেন, “সচেতনতা আস্তে আস্তে ব্যাপক হারে বাড়বে। বর্তমানে হয়তো সেভাবে প্রসারিত হয়নি। সচেনতা বাড়লে বাঘাইড় মাছ ধরা বন্ধ হবে।”