বন্যায় তিন উপজেলার ১০ ইউনিয়নের ৪৮টি গ্রামের অন্তত ২৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
Published : 07 Oct 2024, 12:22 AM
টানা দুই দিন অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোণায় নতুন করে কলমাকান্দা ও পূর্বধলা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া পূর্বধলার একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
রোববার এই দুই উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী ও নিম্নাঞ্চলের লোকালয়ে পানি ঢুকেছে।
এর আগে দুর্গাপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নও প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে তিন উপজেলার ১০ ইউনিয়নের ৪৮টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। এতে অন্তত ২৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
এদিকে সন্ধ্যায় পূর্বধলা উপজেলায় একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ৩০ গ্রাম বন্যার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
নেত্রকোণা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান জানান, জেলার সোমেশ্বরী নদীর পানি দুর্গাপুর পয়েন্টে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। উব্ধাখালী নদীর কলমাকান্দা পয়েন্টে পানি স্থিতিশীল এবং কংশ নদের পানি জারিয়া পয়েন্টে হ্রাস পেয়েছে।
সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ উব্দাখালী নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সোমেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে দুর্গাপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে।
কংশ নদের পানি বেড়ে জারিয়া-জাঞ্জাইল পয়েন্টে বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ১৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবোর প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান জানান, বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ জারিয়া-জাঞ্জাইল পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ৩০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে আর দুর্গাপুর পয়েন্টে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৩০ মিলিমিটার। দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে নেত্রকোণার এই দুই পয়েন্টে। তবে দুপুর থেকে রোদের দেখা মিলেছে।
স্থানীয়রা জানান, কলমাকান্দা উপজেলার নয়াপাড়া, মুক্তিরচর, ধানমহাল, বিশরপাশা, বাউশাম, হরিপুর চকবাজার, আনন্দপুর, বরুয়াকোনা, রংছাতি পাকা সড়কের ওপর দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া কলমাকান্দা সদরসহ লেংগুরা, খারনৈ, রংছাতি, নাজিরপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে এসব এলাকার অন্তত ১৫টি গ্রামে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। পাশাপাশি তলিয়ে গেছে শতাধিক পুকুর, আউশ, রোপা, আমন ধানের জমি।
অতি ভারি বর্ষণের কারণে সীমান্তবর্তী উব্দাখালী, গনেশ্বরী, মঙ্গলেশ্বরী, মহেষখলা নদী, মহাদেও নদ ও পাঁচগাও ছড়ায় পানি বাড়ার কারণে কলমাকান্দা সদরের সঙ্গে চারটি ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে দুর্গাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “শনিবার থেকে টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢলে দুর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগড়া, গাঁওকান্দিয়া ও কাকৈরগড়া ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। এতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। তাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।”
পূর্বধলা উপজেলার দামপাড়া পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের বেড়িবাঁধ সন্ধ্যায় জারিয়ার নাটেরকোণায় আনসার ক্যাম্প এলাকায় ভেঙে গেছে। এই ভাঙন দিয়ে কংস নদ থেকে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। এতে উপজেলার অন্তত চারটি ইউনিয়নে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। এরই মধ্যে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ-জারিয়া ঝাঞ্জাইল রেলপথের পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া ঝাঞ্জাইল স্টেশনের কাছে রেললাইনের কিছু অংশ উপচে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে ট্রেন চলাচল।
এলাকাবাসী জানান, পূর্বধলা উপজেলার দামপাড়া পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের বেড়িবাঁধটি স্থানীয় লোকজন মাটির বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। কিন্তু সন্ধ্যায় বাঁধটি পানির তোড়ে ভেঙে যায়। এ ছাড়া উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের কালিপুর গ্রামের বাড়িঘরে পানি ওঠে গেছে।
উপজেলার জারিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম মণ্ডল নান্টু বলেন, “বাঁধের জারিয়া নাটেরকোণা এলাকায় উপচে দুপুর থেকে পানি গড়াচ্ছিল। পানি গড়ানো রোধ ও ভাঙন ঠেকাতে মাটির বস্তা ফেলে স্থানীয় লোকজন। কিন্তু কংস নদের পানির তোড়ে বিকাল ৫টার দিকে ভেঙে যায় বাঁধটি। ফলে এখান দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে।”
এতে উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে জানিয়ে পূর্বধলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, বন্যায় এরই মধ্যে উপজেলার জারিয়া, ঘাগড়া ও ধলামূলগাঁও ইউনিয়নের ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।”
“বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় আরও নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যার্তদের সাহায্যার্থে পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে।”
পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. খবিরুল আহসান বলেন, “বন্যা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।”
এদিকে কলমাকান্দা উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের সাইদ মিয়া বলেন, “শনিবার রাতে প্রচুর বৃষ্টি হইছে। এই বৃষ্টির পানি আর পাহাড়ি ঢলে আমরার গ্রামে পানি ঢুইক্যা গেছে। বাড়ির বাইরে যাওয়া যাইতেছে না। রান্না করতে সমস্যা অইতাছে। বাড়িতে থাকা গরু-বাছুর লইয়া বিপদে আছি। গরুর খাবার যোগান দেওন যাইতাছে না।”
একই উপজেলার রামনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা মিরাজ উদ্দিন বলেন, “বৃষ্টি আর পাহাইড়্যা ঢলের পানিতে চাইরদিক দিয়া গ্রামডারে বের দিয়ালছে। বাইরোনির বাও নাই। দুর্ভোগের মধ্যে আমরা পড়ছি। ধান ক্ষেত বেবাক তলায়া গেছে। অনেকের পুকুর তলায়া মাছ বাইর অইয়া গেছে। অনেক ক্ষতির মধ্যে পড়ছি আমরা। তবে আইজ সকাল থেইক্যা বৃষ্টি কম। বৃষ্টিডা কইম্যা গেলে কিছুডা রক্ষা।”
উপজেলার কনুড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বশর্মা বলেন, “আমরার বাড়ির উঠানে পানি আইছে। ঘরের মধ্যে উঠে নাই। তবে আমনের জমি সব তলায়া গেছে।”
দুর্গাপুর উপজেলার গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের মুন্সীপাড়া গ্রামের মুহাম্মদ তালুকদার বলেন, “আমাদের চলাচলের রাস্তায় পানি।”
চন্ডিগড় গ্রামের মাসুদুর রহমান ফকির বলেন, “আমাদের গ্রামে অনেক মানুষ পানিবন্দি, হাট-বাজারেও যেতে পারছেন না।”