“পরে মরা গরু পুইত্তা থওয়ার জায়গা না পাইয়া পোলা আর আমি ওই মরা গরু বন্যার পানিতে ভাসাই দিছি।”
Published : 09 Oct 2024, 01:56 PM
শেরপুরের সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদীতে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার উন্নতি হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পর বন্যাকবলিত এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ ভেসে উঠতে শুরু করেছে।
অনেকেই বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে বাড়িঘরে স্যাতেস্যাতে অবস্থা ও কাদা পানিতে একাকার হয়ে থাকায় এবং চুলায় পানি উঠায় রান্নাবান্না করতে পারছেন না বেশিরভাগই।
গ্রামীণ রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। কোথায়ও রাস্তা ভেঙে গেছে, কোথাও বড়বড় গর্ত, খানা-খন্দে ভরে গেছে। আবার কোথাও এখনও জলাবদ্ধতা রয়ে গেছে। এছাড়া খেতের ফসল ডুবে নষ্ট হওয়ায় আগামী দিনে কিভাবে চলবেন এসব ভেবেও অনেক কৃষক পরিবার এখন দিশেহারা।
ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের কুশাইকুড়া গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, “এমনভাবে সব কিছু তছনছ হয়েছে তা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। ঢলের পানির তাণ্ডবে আমাদের বাড়ি ভিটায় ২০-২৫ ফুট গর্ত হয়ে গেছে।
“আমরা ঘরের কোনো কিছু বের করতে পারি নাই। এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে জীবনটা রক্ষা করেছি। পানি নেমে যাওয়ার পর শুধু কয়েক ফর্দ টিন ও কিছু জিনিসপত্র পেয়েছি। আসবাবপত্র টাকা পয়সা, ধানচাল যা ছিল সবই ভেসে গেছে।”
নিরুপায় হয়ে নলকুড়ায় নানার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া এই বন্যাদুর্গত আরও বলেন, “আমাদের বাড়িতে আমার বাবা আব্দুল মালেকের ১টি হাফ বিল্ডিং ঘরসহ টিনসেট সাতটি ঘর, আমার চাচা আব্দুল কাদিরের দুটি এবং চাচাতো ভাই শাহজাদার একটি ঘর পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ভেসে গেছে। প্রায় ৩ একর জমির ধান সবই ঢলের পানিতে আসা বালুর নিচে চাপা পড়েছে।”
এ দিকে পানি কমতে শুরু করায় শেরপুর সদর উপজেলার গাজীরখামার, ধলা, বাজিতখিলা ও পাকুরিয়া ইউনিয়নের আংশিক এবং নকলা উপজেলার নকলা, উরফা, গণপদ্দী ও গৌরদ্বার ইউনিয়নের আংশিক এবং নকলা পৌরসভার আংশিক এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে।
সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের বালুয়াকান্দা গ্রামের কৃষানি শিউলী বেগম বলেন, “বন্যায় ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা গেছে গা। চুলা ভিজা থাকায় রান্না বন্ধ। খাবার পাইতাছি না। আমগরে জমির আবাদ নষ্ট অইয়া গেছে গা। বনকে বন ফসল গেছে গা।”
একই গ্রামের গৃহিনী রহিমা বেগম বলেন, “খাবার-নবার নাই। চুলাত আগুন জ্বলাবার পাইতাছি না। ঘর ভাইঙ্গা গেছে গা। বানের পানিতে খেতের ফসলও খাইয়া গেছে গা।”
কৃষক হাজী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “রাস্তার মধ্যে কোমর পানি। বাড়িঘরে পানি। খাওয়া পিন্দা অসুবিধা। চুলার মধ্যে পানি পাকশাক করা যাইতাছে না। বন্যার আবাদ ফসল, ঘরবাড়ি নষ্ট অইলো। গাছগাছালি নষ্ট অইলো।”
ফসলের এবং মাছ চাষীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
এ বন্যায় কারণে রোপা আমন ধান ও সবজিসহ সব ধরনের ফসলের এবং মাছ চাষীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে জেলায় রোপা আমনের ৪৬ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমির ধান, ১ হাজার ৬২ হেক্টর জমির সবজি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এছাড়া বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বস্তায় আদা চাষ। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে চার লাখ ৬৯ হাজার ২৯৪টির বস্তার আদা।
সদর উপজেলার তারাগড় গাংপাড় গ্রামের কৃষক লিয়াকত উল্লাহ বলেন, “আমার দুই একর জমি আবাদ করছিলাম তা বন্যায় ডুইবা গেছে। অহন কি কইরা খামু?”
গ্রামের স্বর্ণ মিয়া বলেন, “মুরগির খামার দিছিলাম। ৬০০ মুরগি আছিল। বন্যার কারণে অর্ধেক মইরা গেছে। বাকি অর্ধেক অন্যখানে টান জায়গায় নিয়া রাখছি।
“মাত্র ১৫ দিন আগে ১ লাখ ২৫ হাজার টেহা দিয়া একটা গরু কিনছিলাম। বন্যার পানি উঠায় কোনোখানে রাহার জায়গা না পাওয়ায় পানিতে দাড়াইয়া থাকতে থাকতে গরুডা মইরা গেছে।
“পরে মরা গরু পুইত্তা থওয়ার জায়গা না পাইয়া পোলা আর আমি ওই মরা গরু নিয়ে বন্যার পানিতে ভাসাই দিছি।”
তারাগড় গাংপাড় আবাসনের বাসিন্দা মালেকা বেগম বলেন, “রাস্তাঘাট বালা না। কোন খানে যাওন যায় না। রান্না-বান্না খাওয়ার কষ্ট। কামাই রোজগারের জন্য যাওন যাইতাছে না। ”
বিপদসীমার অনেক নিচে নদ-নদীর পানি
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, জেলার পাহাড়ি নদী মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই ও চেল্লাখালীর পানি বিপদসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিনি জানান, বুধবার সকালে নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীর পানি কমে নালিতাবাড়ী পয়েন্টে বিপদসীমার ১৮৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং নাকুঁগাও পয়েন্টে ৩৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চেল্লাখালী নদীর পানি কমে বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়লেও তা বিপদসীমার ৫২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যায় ৫ দিনে মৃত ১০ জন
এদিকে নালিতাবাড়ী উপজেলায় সোমবার বন্যার পানিতে ডুবে জিমি আক্তার নামে ৮ বছরের এক শিশু মারা গেছে বলে জানিয়েছেন ওসি ছানোয়ার হোসেন।
এবং নকলা উপজেলার টালকি এলাকায় রাহিম নামে ৫ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন নকলা থানার ওসি হাবিবুর রহমান।
এ নিয়ে গত ৫ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ জনে ।
তবে বন্যায় মৃতের সংখ্যা মোট ৮ জন বলে জানিয়েছেন শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান।
তিনি আরও বলেন, “বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নকলায় পানি বেড়েছিল তা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির ভাল লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করেছে।”
পানি পুরোপুরি সরে যাওয়ার পর কৃষি, মৎস্য ও ঘরবাড়িসহ ক্ষয়ক্ষতি কোন সেক্টরে কেমন হয়েছে তা জানার পর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি বলেন, “আপাতত বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ ও সংস্কার করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে টেউটিন ও নগদ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া বন্যা কবলিত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা পুরোদমে চলছে। জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও বিজিবির পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। “
আরও পড়ুন
শেরপুরে বন্যার উন্নতি, কৃষি-মাছের ব্যাপক ক্ষতি
শেরপুরে বন্যা: উজানে উন্নতি হলেও ভাটিতে অবনতি
বন্যা: তিন জেলায় পানিবন্দি সোয়া লাখ পরিবার, ৫ জনের মৃত্যু
শেরপুরের বন্যা ছড়িয়েছে ৫ উপজেলায়, ফসল ও মাছের ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি