লানঝৌতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু বাংলাদেশি ছাত্র এবং গবেষক আছেন। তাদের মধ্যে দুজন আমাদের বেশ ঘনিষ্ঠ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র আরিফ আর শাকিল এখন লানঝৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে। ওরা অনেকদিন থেকেই আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছিল লানঝৌতে যাওয়ার জন্য। সময় আর সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এবারে ঈদ তাই লানঝৌতে করতে মনস্থির করলাম।
লুঝৌ থেকে লানঝৌ আকাশপথে মাত্র সোয়া এক ঘণ্টার। ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বাংলাদেশি ছাত্র। শেষ রোজার ইফতারি করলাম এক মসজিদে। প্রচুর চীনা এবং বিদেশি মুসলিম এখানে একসঙ্গে ইফতার করেন নিয়মিত, এবং অবশ্যই মসজিদের পক্ষ থেকে। নামাজে ইমাম সাহেবের তিলাওয়াত শুনে মনে বেশ শান্তি এলো। চাইনিজ ইমাম, কিন্তু এত বিশুদ্ধ আর সুরেলা তিলাওয়াত কমই শোনা যায়। জানতে পারলাম তিনি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
পরদিন ঈদের নামাজে দেখা হলো দেশ-বিদেশের অনেক মানুষের সঙ্গে। লানঝৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশত মুসলিম ছাত্র, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। দুপুরে আমরা গেলাম লান শান পর্বতে। চূড়া থেকে লানঝৌ শহরের একাংশ বেশ ভালোভাবে দেখা যাওয়ার কথা, কিন্তু সেদিন ছিল বর্ষণমুখর দিন। ঘনমেঘের কারনে ঠিকমত শহর দেখা গেল না। তবে আড্ডা হলো বেশ।
পরদিন লানঝৌ এর বাংলাদেশি সমাজ খানাপিনার আয়োজন করল বিখ্যাত 'হোয়াংহা' কিংবা 'ইয়েলো রিভার' এর তীরে। চীনের দুঃখ নামে পরিচিত এই নদী দেখার খুব ইচ্ছে ছিল; তা পূর্ণ হয়ে গেল। ঘোলা পানি দেখতে হলুদাভই লাগে, তার মাঝে জেগে থাকা সবুজ গাছপালায় ঢাকা দ্বীপগুলো দেখে মানিকবাবুর 'হলুদ নদী সবুজ বনে'র কথাই মাথায় এলো আমার।
বিকেলে আমরা ছুটলাম ঝাংইয়ে শহরে বিখ্যাত 'দান-সিয়া' বা 'রেইনবো মাউন্টেইন' বা 'রঙধনু পর্বত' দেখতে। নয়নাভিরাম সেই পর্বত-ভ্রমনের অভিজ্ঞতার ছোট একটা বর্ণনা দিয়েছি পূর্বের চীনের রঙধনু পর্বত লেখায়।
দেড়দিন পর লানঝৌ ফিরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'লিন-সিয়া' শহরে। একটা বিয়ের দাওয়াত সেখানে। আমরা লানঝৌতে দেখেছি প্রচুর মসজিদ আর হালাল খাবারের দোকান। যেহেতু মুসলিম বেশি, তাই এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু 'লিন-সিয়া'তে আমাদের জন্য বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। এ যেন এক মসজিদের শহর! মাত্র আশি বর্গকিলোমিটারের এই শহরে শ'খানেকের বেশি মসজিদ। আকৃতিতে বেশ বড়, কোন কোন মসজিদে একসঙ্গে হাজার দুই মানুষ নামাজ আদায় করতে পারে।
আর মসজিদের কারুকার্যের কথা কি বলব! আবহমান চীনা স্থাপত্য আর ইসলামিক স্থাপত্যের এ এক অনন্য মিশ্রণ। আর মসজিদ কি শোভা-বর্ধনের জন্য? অবশ্যই তা নয়। যে সময়টুকু এখানে ছিলাম একেক ওয়াক্তের নামাযে একেক মসজিদে গিয়েছি। মুসুল্লিতে পরিপূর্ণ! রাস্থায় প্রচুর দাড়িওয়ালা মানুষ, আর হিজাব-ছাড়া মহিলা দেখাই যায় না প্রায়। তবে গানসুর এই বিশাল মুসলিম সমাজের অধিকাংশই দরিদ্র। কৃষিকাজ আর ছোটখাট ব্যবসাই তাদের জীবিকা অর্জনের উপায়।
আমরা চারজন বিয়েতে গিয়েছিলাম কনে-পক্ষের আমন্ত্রণে। নানাবিধ খাওয়া-দাওয়ায় প্রথম দিন পার করলাম। পরদিন সকালে আমাদের চলে আসার কথা। কনের বাবা-মা আমাদের অনুরোধ করলেন, আমরা যাতে মেয়েকে বিদায় দিয়ে আর বর-পক্ষের লোকজনকে খাইয়ে দিয়ে যাই। কারন আমরা তাদের মেয়ের 'ভাই'। আমরা অতি আনন্দের সঙ্গে ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করলাম। এই পরিবারের আতিথেয়তা আর ভালোবাসা মনে থাকবে সুন্দর স্মৃতি হয়ে। এদের বিবাহে নাই অপ্রয়োজনীয় খরচের ঘনঘটা, নেই টাকা-পয়সার লেনদেন কিংবা খাবারদাবার নিয়ে ঝগড়াঝাটি, নেই অশ্লীল গানবাজনা কিংবা হুড়াহুড়ি। অতি সাধারণ এবং পবিত্র এক শান্তির দেখা পেলাম বিবাহের অনুষ্ঠানে, যেমনটা হওয়া উচিত মুসলিম বিয়েতে।
চীনের মধ্যে লিন-সিয়ার মতো এরকম এক শহর পাবো তা ছিল আশাতীত। লিন-সিয়া থেকে লানঝৌ হয়ে লুঝৌ ফিরলাম। পুরো যাত্রাপথ আর ফেরার পরেও আচ্ছন্ন হয়েছিলাম সপ্তাহখানেকের এই সুন্দর অভিজ্ঞতায়। এই মানুষদের ধর্মবোধ, নিষ্ঠা, আচার-ব্যাবহার, জীবন-যাপন শ্রদ্ধাই জাগাবে শুধু।
লেখক পরিচিতি: চীনের লুঝৌ এর সাউথওয়েস্ট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা ও অধ্যাপনা করছেন।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |