চীনের 'ট্যুরিস্ট হটস্পট' এর তালিকায় 'ইবিন' এর নাম তেমন একটা আসে না। কিন্তু সিচুয়ান প্রদেশের দক্ষিণে ইয়াংজে আর মিন নদীর সংযোগস্থলে গড়ে ওঠা 'ইবিন' অসাধারণ সুন্দর।
Published : 16 Nov 2016, 05:20 PM
'ওরা তো আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করে জিতেছে'
ভিয়েতনামের দিনলিপি: শুরুর দিনগুলো
ইবিনে'র এক পাহাড়ে গিয়েছিলাম। চীনা ভাষায় 'যুহাই', ইংরেজিতে 'ব্যাম্বো সি'। তাই আমি বাংলায় নাম দিয়েছি 'বাঁশের সমুদ্র'। ১৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাঁশে ঢাকা এই পার্বত্য অঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।
লুঝৌ থেকে দুপুরের পর রওনা হয়ে ইয়াংজে নদীর ধার ঘেঁষে চলতে চলতে সন্ধার দিকে যুহাই এ ঢুকে পড়লাম। আমরা চারজন। সফরসঙ্গী তিন অধ্যাপক- চেন সাহেব, ফু সাহেব, ঝাং সাহেব।
বেশ একখানা জঙ্গলমত জায়গায় বড়সড় কয়েকটি হোটেল পাশাপাশি। রুমে ব্যাগ রেখে নামাজ শেষ করে নিচে নেমে দেখি অধ্যাপক সাহেবরা অপেক্ষা করছেন- খেতে হবে। ক্ষুধার্ত ছিলাম, কিন্তু আমার খাওয়ার উপযোগী তেমন কিছুই নেই। প্রায় সবকিছুতে মাংস মেশানো। সালাদের বাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম; তাদের একজন উঠে রান্নাঘরে গিয়ে কিছু একটা বলে আসলেন।
কিছুক্ষণ পর ওয়েটার বেশ বড় এক থালা ভরে ২-৩ রকমের মাশরুম, কচি বাঁশ আর মেটে আলুর এক পদ নিয়ে এলো। সিচুয়ানের বিখ্যাত ঝাল রেসিপি। আমি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ঝাং সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি হেসে বললেন, "তোমার জন্য"।
মধ্যরাতে কফি নিয়ে বারান্দায় আসলাম। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বাঁশ কিংবা অন্যান্য গাছের উপর দিয়ে পশ্চিমে হেলে পড়া চাঁদের দেখা পেলাম। দশমী কিংবা একাদশী হবে হয়ত। পাহাড়, জঙ্গল, নিস্তব্ধতা, স্বচ্ছ চাঁদের আলো- আহা! কি এক মায়াবী রাত।
একটু ঘুম এসেছিল ভোরের দিকে, হয়ত ঘন্টাখানেকের জন্য। পাখির ডাক আর ঘড়ির অ্যালার্মে সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। আফসোস নেই। ঘুমানোর অনেক সময় পাওয়া যাবে জীবনে। কিন্তু পাহাড়ী জঙ্গলে এমন চন্দ্রালোকিত রাত আর কি আসবে!
বেশ সকাল সকাল আমরা নাস্তা করে বের হলাম। অনেক পর্যটক। পাহাড়ি রাস্তায় একেবেঁকে আমাদের গাড়ি আরো উপরে উঠছে। কখনো দুপাশে ঘন বাঁশের জঙ্গল, কিংবা কখনো ডানে কখনো বামে গভীর খাদ। গাড়ি থামল। সামনে 'কেবল কার'। ছোট ঝুলন্ত গাড়ি (নাকি খাঁচা) রশি ধরে আমাদের পার করবে পাহাড়ের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
স্বচ্ছ টলটলে পানি। অনেকগুলো বাঁশের ভেলা আছে। আমরা একটা ভাড়া করে হ্রদের পানিতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। আমাদের চারজনের বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থান সব তুচ্ছ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল আমরা চার কিশোর ঘুরতে বেড়িয়েছি বন্ধনহীন উদ্দামতায়। সেই ছেলেবেলায় পুকুরে কলাগাছের ভেলা নিয়ে ঘোরার মত করে আনন্দ করলাম।
একসময় খোলা জায়গায় এক বাঁকে এসে পেছনের হেঁটে আসা পথটা দেখা গেল। এটা আসলে পাহাড় কেটে পাহাড়ের গায়ে বানানো সরু শহর। কয়েকশ বছর আগে বৌদ্ধ পুরোহিতরা বানিয়েছেন এই শহর। তাই মাঝেমাঝেই দোকানপাট চোখে পরছিল। মাঝখানে বিশাল বুদ্ধমূর্তি আর ঝর্ণাও দেখা গিয়েছিল।
পাহাড়ি সবজি, কচি বাঁশ আর মাশরুম দিয়ে তৈরি খাবার। সেই সাথে সিচুয়ানের ঝাল দিয়ে বনমোরগের ভুনাতো ছিলই। অনেক হাঁটা আর পরিশ্রমের পর এই খাওয়া। গলা পর্যন্ত খাওয়া যাকে বলে, তাই হল।
এবার ফেরার পালা। বাঁশের সমুদ্রে অবগাহন শেষে 'যুহাই' থেকে বেড়িয়ে আমরা ইবিন হয়ে লুঝৌ এর পথ ধরলাম। মাত্র একরাত একদিন। কিন্তু সেই পাহাড়ি-জঙ্গলে কাটানো রাত, চাঁদের আলো, বাঁশের সমুদ্রের উপর দিয়ে 'কেবল কার'-এ ভ্রমণ, হ্রদের পানিতে বাঁশের ভেলা, পাহাড়ের গায়ে সরু শহর, পাহাড়ী খাওয়া-দাওয়া আর ঝর্ণা।
লেখকের কথা:
আমি লেখক নই। জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশুনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এখন ভিয়েতনামে থাকলেও চীনে ছিলাম অনেক দিন। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি