ছ'বছর আগে গ্রীষ্মের এক দুপুরে জীবনে প্রথম বারের মতো বিমানে চেপে বসেছিলাম। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে, চীনের উদ্দেশ্যে, যে দেশ সম্পর্কে বিশেষ কোন ধারণাই ছিল না। সামনে 'উচ্চশিক্ষা', 'ডিগ্রি', বিদেশি আরাম আয়েশের জীবনের হাতছানি, আর সাথে নতুন বউ- মন বেশ আনন্দিত আর ফুরফুরে থাকার কথা কথা ছিল।
Published : 16 Oct 2016, 07:37 PM
কিন্তু বাড়িতে ফেলে আসা আম্মার কান্নাভেজা মুখ আর বাংলাদেশ বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারে আব্বার বিষণ্ণ মুখ কোনভাবেই আনন্দিত হতে দিচ্ছিল না।
প্রিয় জন্মভূমি আর প্রিয় মানুষদের ছেড়ে যাচ্ছি- এই কথা মনে হতেই বিশাল এক শূন্যতা আর হাহাকার তৈরি হচ্ছিল বুকের ভেতরে। কেমন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে তিন দিন সময় নিয়ে কুনমিং-বেইজিং হয়ে চ্যাংশা পৌঁছলাম! প্রায় পনের দিন কেটে গেলো মনের গুমোট ভাবটা কাটতে। ধীরে ধীরে নতুন দেশে নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে শুরু করলাম আর এক সময়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
ছাংশা-তে চার বছরের পড়াশুনা শেষে যখন প্রায় সবাই নিজ দেশে বা অন্য কোথাও চলে গেলো, আমরা এলাম ইয়াংজে নদীর পারে শ্যামলা রঙের ছোট শহর লুঝোউ-তে। দুই বছর এখানেও কেটে গেলো।
ছোট জীবনের ছয় বছর কম সময় নয়। সুবিশাল এবং সুন্দর চীন দেশের চমৎকার বন্ধুসুলভ মানুষগুলোর সাথে কাটানো অর্ধযুগের অভিজ্ঞতা জীবনের এক বিশেষ প্রাপ্তি। এত এত মানুষের সাথে এত এত স্মৃতি! তবে সুবিশাল এই দেশের বিভিন্ন এলাকার বিচিত্র সংস্কৃতির বিচিত্র মানুষের বিচিত্র আচরণের কতটুকুই বা দেখেছি!
ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। চীনারাও তাই। ফেরার সময়ে, কেন জানি এদের সব 'মন্দ' দিক ভুলে যেতে ইচ্ছে করলো। তাই হোক, অন্যের মধ্যে যা কিছু ভালো, তা যদি শিখে নেয়া যায় আর মন্দকে যদি দূরে সরিয়ে রাখা যায়, তাতেই কল্যাণ।
গল্প: ০১
ছেলের জন্মের পর ওর বয়স তিন বছর হওয়া পর্যন্ত যতদিন ভীড়ের বাসে উঠেছি, কোনদিন ওকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। ছোট বাচ্চা নিয়ে কেউ বাসে উঠলে, কিংবা গর্ভবতী কেউ অথবা বৃদ্ধ কেউ বাসে উঠলে তাকে অবশ্যই সিট ছেড়ে বসতে দিবে কেউ না কেউ।
এমন যদি হয়, মানুষজন লক্ষ্য করেনি, চালক সাহেব বলবেন। এবং যতক্ষণ না ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা গর্ভবতী মহিলা বা বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি বসতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত চালক সাহেব বাস ছাড়বেন না! পশ্চিমা দুনিয়ার মতো এখানে বাস ফাঁকা থাকে না; দেড়শ’ কোটি মানুষের দেশ- শহরের বাসই প্রধান বাহন এবং সেখানে প্রচুর ভিড় হয়।
চীনের সব প্রায় বাসেই দুইটা দরজা। সামনে দিয়ে মানুষ ওঠে, বক্সের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা রাখে কিংবা ডিজিটাল কার্ড দিয়ে ভাড়া দিয়ে ভেতরে ঢুকে আর পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়।
অনেক সময় ভিড় বেশি থাকলে মানুষ পেছনের দরজা দিয়ে উঠে ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে ভাড়া দিয়ে আসে। আমি আমার এক চীনা বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম "আচ্ছা কেউ টাকা মেরে দেয়ার চেষ্টা করে না? যেমন পেছন দিয়ে উঠল, সামনে গিয়ে টাকা দেয়ার কি দরকার?"
সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে উত্তর দিল, "সেরকম কেন করবে? টাকা দেয়াই তো নিয়ম।"
আমি আর কথা বাড়াইনি; প্রশ্নের কথা ভেবেই লজ্জা পাচ্ছিলাম।
গল্প: ০২
সিয়াংইয়া স্কুল অফ মেডিসিন- এর তিন নম্বর দরজা দিয়ে ঢুকতেই একটা ফলের দোকান ছিল। এক দম্পতি তাদের ছোট বাচ্চা নিয়ে দোকান চালাতেন। একদিন ফল কেনার সময় এক বন্ধুর সাথে কথা বলতে বলতে ফল বাছাই করে পলিথিন ব্যাগে নিচ্ছি।
হঠাৎ দোকানি ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, “আরে আরে করছ কি! দুয়েকটা ফল একটু পচে গেছে; তুমি তো দেখছি ওইগুলোই তুলছ! ঠিক আছে, তুমি কথা বল, আমি তুলে দিচ্ছি!”
তিনি যত্ন করে ব্যাগ থেকে পচা ফলটি তুলে নিয়ে তাজা ফলগুলো তুলতে লাগলেন। তাদের দোকান ওখানে বেশিদিন ছিল না; মাত্র বছর দেড়েক পরে অন্য কোথাও চলে যায়।
কিন্তু যতদিন তারা ছিলেন এই শহরে আমি তাদের দোকান ছাড়া অন্য দোকান থেকে কখনই ফল কিনতে যাইনি। 'সৎ ভাবে ব্যবসা' বোধ হয় একেই বলে।
গল্প: ০৩
চীনের অধিকাংশ শহরেই গরুর মাংস বিক্রি হয় হাড় এবং চর্বি ছাড়া (একেবারেই 'সলিড' মাংস); অবশ্য দামটাও একটু বেশি। এজন্য মাংসের হাড়ের স্বাদ পেতে হলে দেশে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
একদিন হালাল মাংসের দোকানে গিয়ে দেখলাম বেশ বড় একটা মাংসের টুকরো হাড়সহ ঝোলানো। আমি বিক্রেতাকে অনুরোধ করলাম হাড়সহ দিতে। উনি একটু হাসলেন। তারপর ধীরে ধীরে হাড় থেকে মাংস খুলে ফেললেন। আমি ভাবলাম উনি হয়ত আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা চাইনিজ উচ্চারণ বুঝতে পারেননি।
তিনি হাড় সরিয়ে মাংসের ওজন করলেন, দাম নির্ধারণ করলেন, তারপর আরেকটি বড় চাপাতি এনে হাড় কেটে ছোট করে মাংসের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। যেহেতু হাড় তারা বিক্রি করেন না, আমাকে বিনামূল্যেই দিয়ে দিলেন!
'সৎ ভাবে ব্যবসা'র সংজ্ঞা আরেকবার জানলাম।
লেখকের কথা
আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। জীবন আমার কাছে বৈচিত্র্যময় এবং একই সাথে মাধুর্যময়। জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি। পড়াশুনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে ভিয়েতনামে থাকলেও চীনে ছিলাম প্রায় ছয় বছর। মাঝে কিছু সময় কাটিয়েছি ম্যাকাওতে।
এখানে ওখানে ছোটাছুটি করার সময় যেসব টুকরো অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেগুলো খুব কাছের কিছু বন্ধুবান্ধবের সাথে বলতাম; কখনো আড্ডায়, কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সাধারণত প্রাচ্যের দেশগুলোতেই ঘুরেছি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমার প্রথম প্রবাস চীনের কিছু অভিজ্ঞতা দিলাম।
লেখক: বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকিউলার বায়োলজির ছাত্র