কৃষিপ্রধান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভিয়েতনামের নাম শুনলে শুরুতেই ‘যুদ্ধ’ শব্দের কথাই মনে পড়ে অধিকাংশের। প্রায় তিন দশক ধরে চলা ভিয়েতনামের যুদ্ধের স্মৃতি এখানে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, বিশেষ করে হো চি মিন শহরে।
Published : 17 Dec 2016, 05:47 PM
এই শহরটিই ছিল প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। তখন অবশ্য এর নাম ছিল ‘সাইগন’। পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন করা হয়। ভিয়েতনামে আসা যখন নিশ্চিত হল,তখনই পরিকল্পনা ছিল এই দেশের যুদ্ধকালীন স্মৃতির খোঁজ করে বেড়াব আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাদ নেব কাজের ফাঁকে ফাঁকে।
ভিয়েতনামের যুদ্ধের অনন্য নিদর্শন ‘কু চি’ টানেলের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। সুযোগ এসে গেল। লোকাল ভাষায় ‘গুউ চি’ উচ্চারণ করা হয় একে।
‘কু চি’ টানেল আধুনিক ভিয়েতনামের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধে টিকে থাকতে ‘ভিয়েত কং’ বাহিনী যেসব ব্যবস্থা নিয়েছিল, তার মধ্যে এই ‘কু চি’ টানেল অন্যতম।
ভিয়েত কং বাহিনী এই টানেল তৈরি করেছিল মূলত তাদের লুকানোর জায়গা হিসেবে। তবে তারা এর ব্যাপক ব্যবহার করেছিল খাদ্যসামগ্রী এবং যুদ্ধের রসদ পরিবহনে, এবং সেইসাথে বাসস্থান এবং হাসপাতাল হিসেবে।
যদিও মূল টানেল অর্ধেকের বেশি সময়ের আবর্তনে বন্ধ হয়ে গেছে,ভিয়েতনাম সরকার ১২১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের টানেল সংরক্ষণ করে ‘কু চি’র ‘বেন ডিন’ আর ‘বেন ডুওক’ এলাকায় ‘ওয়্যার মেমোরিয়াল পার্ক’ হিসেবে খুলে দিয়েছে পর্যটকদের জন্য।
প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকদের ভ্রমণে ‘কু চি’ যেন জেগে ওঠে ইতিহাসের পাতা থেকে। ইউ টিউবে অনেক ডকুমেন্টারি আছে ‘কু চি’র ওপরে। কেউ চাইলে দেখতে পারেন। ভাল লাগবে আশা করি।
আমরা সাড়ে চারজন বাংলাদেশি বেশ বড়সড় একটা পর্যটকদলের সাথে। জাকির সাহেব, জামান সাহেব, নুরুল ইসলাম সাহেব আর মধ্যমণি ছোট্ট জানি সাহেব আমার সফরসঙ্গী। হো চি মিন থেকে খুব সকালে রওনা হলাম। দেড় থেকে দু’ঘণ্টা লাগার কথা বাসে। কিন্তু ‘কু চি’র দিকে না গিয়ে আমাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ‘তাই নিন’ শহরের ‘ক্যাও দাই’ উপাসনালয়ে।
মাত্র শত বছরের কাছাকাছি বয়সের নতুন ধর্মের এই উপাসনালয় বেশ বড়সড় জায়গা নিয়ে করা হয়েছে। মূল উপাসনালয় ভবনটি বেশ সুদৃশ্য, অনেকটা রাজপ্রাসাদের মত। আগ্রহী পর্যটকরা উপাসনালয়ের ভেতরে ঘুরে আসলেন, আমি অবশ্য সেখানকার চারপাশের প্রকৃতি নিয়েই ব্যাস্ত ছিলাম। পাশের বাগানে অনেক বানর খেলাধুলা আর নানা কীর্তিকলাপের মাধ্যমে মানুষকে বেশ আনন্দ দিয়ে বেড়াচ্ছিল।
টিকেট কেটে অফিস পার হয়ে ভূগর্ভস্থ রাস্তা দিয়ে আমরা যেখানে উঠে আসলাম, সেখানে চারদিকে তাকিয়ে কেমন যেন গা ছম ছম করে উঠল। এই সেই বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত?) যুদ্ধক্ষেত্র। মোটামুটি ঘন বন। মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা জঙ্গল সরিয়ে কয়েকটি পাতার তৈরি কুঁড়েঘর দেখা গেল। বুঝতে পারলাম, এগুলো ভিয়েত কং যোদ্ধাদের নিবাস ছিল। হামলা শুরু হলে এইসব কুটির ছেড়ে তারা টানেলে ঢুকে পড়তো।
গাইড আমাদের নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। খানিক পরে আমাদের নিয়ে যেখানে দাঁড়ালেন, সেটা একটা ফাঁদ। একে ‘টাইগার ট্রাপ’ বলে। ঘাসের জমিনে গর্ত করে ওপরে এমনভাবে ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে, দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে কেউ পা দেওয়ার সাথে সাথেই তাকে নিয়ে এক টুকরা কৃত্রিম জমিন ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যাবে। আর সেই সাথে তাকে বিদ্ধ হতে হবে নিচে খাড়াভাবে সাজিয়ে রাখা ধারালো ফলায়।
খানিক এগিয়ে শুকনো পাতা সরিয়ে গাইড সাহেব ৬০ ইঞ্চি/৪০ ইঞ্চি আকারের একটা কাঠের পাত সরিয়ে আনলেন। এটা টানেল থেকে মাথা উঁচু করে চারদিক পরখ করে নেয়ার একটা বহির্মুখ। একটু সামনে এগিয়ে বেশ বড়সড় একটা মুখ পাওয়া গেল টানেলের। এটা নাকি অন্যতম প্রধান প্রবেশ মুখ ছিল। তবে এই টানেল পথের অধিকাংশই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এখান দিয়ে তাই ঢোকা নিষেধ।
পাশের জঙ্গলে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাটির ছোট ছোট ঢিবি। আপাতদৃষ্টিতে এই মাটির ঢিবিকে সাধারণ উঁইপোকার ঢিবি মনে হলেও টানেলে এগুলোর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এগুলোর মধ্যে ছোট ছোট গর্ত করে বাঁশের চোঙ দিয়ে টানেলের মধ্যে অক্সিজেন প্রবাহ নিশ্চিত করা হত।
পথের পাশে একটা ট্যাংক দেখা গেল। আমেরিকা বাহিনীর পরিত্যক্ত। তার সামনে কিছুদুর এগিয়ে দেখা গেল লম্বা একটা ঘরে সাজানো যুদ্ধকালীন সময়ে তৈরি বিভিন্ন রকমের ফাঁদের মডেল: 'উইন্ডো ট্র্যাপ', 'ফোল্ডিং চেয়ার ট্র্যাপ', 'সুইঙ্গিং আপ ট্র্যাপ', 'ফিশ ট্র্যাপ', 'সি-সও ট্র্যাপ', 'রোলিং ট্র্যাপ', 'ক্লিপিং আর্মপিট ট্র্যাপ', 'স্টিকিং ট্র্যাপ', আর 'ডোর ট্র্যাপ'।
রাস্তা ধরে আরেকটু সামনে এগিয়ে একটা যাদুঘরের মত দেখা গেল। যুদ্ধকালীন সময়ে ব্যবহার করা অস্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে এখানে। একে-৪৭, এম-ষোল, এম-ষাট ইত্যাদির দেখা মিলল। কেউ চাইলে বুলেট কিনে সামনের শুটিং রেঞ্জে এগুলো দিয়ে ফায়ার করা যায়।
সেখান থেকে বেড়িয়ে আমরা যেখানে গেলাম সেখানে দুই-তিনটা বড় বড় টানেল মুখ। মডেল বানিয়ে এখানে কীভাবে টানেল তৈরি করা হয়েছে, তা দেখানো হয়েছে। পাশে দু’টি ঘর।একটাতে সৈন্যদের জন্য পোষাক বানানো হত, আর আরেকটাতে রাবারের স্যান্ডেল।
বলা হয়নি,‘কু চি’তে আসার সময়ে দেখেছিলাম, রাস্তার দু’ধারে বিশাল সব রাবারের বন। পাশেই এক বড়সড় ডোবার মত। পানি নেই। গাইড জানালেন,বোমার আঘাতে এই বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে এখানে। পথের ধারে এরকম বিভিন্ন আকারের অনেক গর্তের চিহ্ন চোখে পড়ে।
আট -দশ মিনিট লাগল আমাদের। টানেল থেকে বেড়িয়ে দেখি ঘেমে ভিজে গেছি। আর সেই সাথে ক্লান্তির গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস আর বুক ধরফর! মাত্র আট -দশ মিনিটে সহজ পথেই এই অবস্থা! যাদের বছরের পর বছর এই টানেলে থেকে যুদ্ধ করতে হয়েছে অথবা মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়েছে রসদ নিয়ে, কিংবা জীবন বাঁচাতে বা জীবন দিতে হয়েছে তাদের কী ভয়ানক দিনই না কাটাতে হয়েছে, ভাবতেই শিউরে উঠলাম!
আমি বেশ খারাপ বোধ করলাম। হায়! যুদ্ধ কখনই শান্তি বয়ে আনেনা। যুদ্ধ মানেই হাজারো কিংবা লাখো অসহায় নিরপরাধ মানুষের কষ্টের দিন, মৃত্যুর দিন।
এরপরে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম হাসপাতাল, আর রান্নাঘর। দুটো ঘরই মাটির নিচে। ভূমির ওপরে শুধু পাতার ছাউনী। খুব ছোট এক কক্ষে একটি অপারেশন টেবিল দেখা গেল। ভাবছিলাম, বছরের পর বছর কত মানুষ এই টেবিলে শুয়ে উন্নত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর ছোঁয়া অনুভব করেছিল। আহত অবস্থায়, শেষ সময়ে নিশ্চয়ই তাদের চোখে বাঁচার আকুতি ছিল। কান পাতলে বুঝি এখনো শোনা যাবে তাদের আর্তনাদ। নাকি বোমার শব্দে সেই আর্তনাদও ভেসে যাবে!
রান্নাঘর থেকে বেশ একটু দূরে মাটির ঢিবির ছোট ছোট মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে দেখা গেল। এটাই চিমনি রান্নাঘরের। শত্রুকে ধোঁকা দিতে এই বিশেষ ব্যবস্থা। মিষ্টি আলু আর বাদাম, চিনির গুঁড়া দিয়ে তৈরি বিশেষ এক ধরনের খাবার মুখে নিয়ে দেখলাম। যুদ্ধকালীন সময়ে এটি এখানকার অন্যতম খাবার ছিল, যদিও ভাতই এদের প্রধান খাদ্য।
আমরা ঘুরে ঘুরে চলে আসলাম বনের মধ্যে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ছোট এক অডিটোরিয়ামে 'কু চি' টানেলের উপর ডকুমেন্টারি দেখলাম একটা। তারপর ফেরার পালা। দুই দিকে ঘন রাবার বন রেখে বাস যখন ‘কু চি’ ছেড়ে হো চি মিন শহরের পথ ধরল, অস্তগামী সূর্য তখন দিন শেষের জানান দিচ্ছে। চোখ বুজে বুঝি অর্ধ শতাব্দী আগে ফিরে গেলাম।
তারও অনেক পরে,রাত যখন গভীর, টানেলের ভেতর থেকে ভেসে আসে একজন মধ্যবয়সী মানুষ, এক কিশোরী আর এক শিশুপুত্রের ডুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজ। বাকি সব নিস্তব্ধ।
লেখকের কথা:
আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!