প্রবাসীর কালবৈশাখীর স্মৃতি

আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের কথা। একবার বৈশাখের শুরুতে কুষ্টিয়ার চৌড়হাসে মুকুল সংঘ নাট্যগোষ্ঠীর আয়োজনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।

মাহবুব মানিক, জার্মানির হালে থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2018, 05:15 AM
Updated : 30 May 2018, 05:15 AM

অনুষ্ঠান শুরু করে সবে মাত্র ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি গাওয়া হয়েছে। অমনি কালবৈশাখী ঝড় এসে সব উড়িয়ে দিয়ে গেল। মঞ্চের বাঁশ ভেঙ্গে একাকার। শামিয়ানার লাল-নীল-হলুদ কাপড় ছিঁড়ে-ফেড়ে এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ল। কোথায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আর কোথায় সভাপতি! কারো কোন খোঁজ নেই। ধুলা-বালিতে মাখামাখি হয়ে যে যার মতো পালিয়ে চলে আসলাম বাসায়।

দেশে এখন জ্যৈষ্ঠ মাস, কয়েকদিন আগে বৈশাখ মাস শেষ হয়ে গেছে। বাংলা মাসের আবহ এখন আমার শুধুই স্মৃতি। আমাদের দেশে বছর ঘুরে চৈত্র-বৈশাখ মাসের মূর্তিমান আতংক বলতেই কালবৈশাখী ঝড়। যদিও ঝড়ের মুহূর্তগুলো থাকে রোমাঞ্চকর আবার ভয়ংকরও বটে। তবুও আতংকিত মুহূর্তগুলো আমাদের মতো দেশ থেকে দূরে থাকা মানুষের কাছে যথেষ্ট স্মৃতিময় হয়ে ওঠে।

টিভি বা পত্রিকাতে যখন খবর পাই দেশে ঝড় উঠেছে, কষ্টই লাগে বটে। ফেলে আসা দিনের কথা ভেবে কষ্ট পাই। প্রবাসে বসে খুব অনুভব করি চিরচেনা সেই ফেলে আসা কালবৈশাখী ঝড়ের রোমাঞ্চিত মুহূর্তগুলো। ঝড় শেষে কাঁচা আমে গড়াগড়ি, আম গাছের তলা আজ শুধুই স্মৃতি। দীর্ঘ চারটি বৈশাখী মৌসুম পেরিয়ে গিয়েছে, কালবৈশাখীর সঙ্গে দেখা হয়নি।

জার্মানির এই কংক্রিটের শহরে মাঝে মধ্যে ঝড়-বৃষ্টি হয় বটে, তবে তা কালবৈশাখীর কাছে পানসে মনে হয়। জার্মানির ঝড়ের হম্বিতম্বি নিতান্তই শিশুতুল্য কালবৈশাখী ঝড়ের কাছে।

দেশে যখন কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়, আমাদের ঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতিটাও হতো অন্যরকম মজার। চকচকে রোদ ঢেকে হঠাৎ করেই আকাশ কালো হয়ে যেত। যেন-তেন কালো নয়, ঘন কুচকুচে কালো। রাস্তার ছোট ছোট দোকানপাট বন্ধের সেকি প্রাণপণ চেষ্টা! পথে আটকে পড়া মানুষগুলোর দিগ্বিদিক ছুটোছুটি চলতো নিরাপদ একটি আশ্রয়ের খোঁজে। ততক্ষণে ধুলোমিশ্রিত ঝড়ো বাতাসে মাথার চুলে ধুলোর আস্তরণ পড়ে যেতো।

রিক্সা-ভ্যান শুন্য হয়ে যেতো প্রধান সড়ক। ছোট্ট চায়ের দোকানে ছাউনির টিন তখন অনিয়ত বাতাসে ঝনঝন করে কেঁপে কেঁপে উড়ে যাবার চেষ্টায় মত্ত। রাস্তার ধুলাবালি তখন আমাদের মাথার চুল মাখিয়ে শুন্যে দাঁপিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রস্তুত। শন-শন করে ছুটে চলতো একমুখো বিক্ষিপ্ত বাতাস। রাস্তায় ততক্ষণে আমাদের ধুলা গোসল হয়ে যেতো। চুল ভর্তি ধুলা, জামার পকেটে ধুলা, চোখের মধ্যে ধুলার পড়ত।

ঘরের বাইরে দড়িতে শুকোতে দেওয়া জামা-কাপড় দমকা বাতাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার। কোনটা কারো ঘরের চালে, কোনটা উড়ে গিয়ে পড়েছে পুকুরে। ঘরে ঘরে চলতো জানালা-দরজা বন্ধের প্রস্তুতি। তাও উদ্ধত ধুলাবালি আটকে রাখা ছিল দুস্কর। সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাতাসের ছুটে চলার সেকি প্রাণবন্ত চেষ্টা।

ভয়ঙ্কর আর্তনাদে জানালার ফাঁকা জায়গাটুকুতে বেজে উঠতো জেট প্লেনের মতো বাতাস কাটা শোঁ শোঁ শব্দ। গুড়ুম গুড়ুম মেঘের গর্জন কানের পর্দা কাঁপিয়ে দিতো। কিছুক্ষণ পর পরই বিকট শব্দ আর বিদ্যুতের আলোতে ঝলসে উঠতো কালো আকাশ।

হঠাৎ করেই ঝম ঝম শব্দে মোটা মোটা বৃষ্টির ফোটা মাটিতে নামিয়ে দিতো উড়ন্ত ধুলাবালি। একসময় শীতল বাতাসের শক্তির সাথে যোগ দিতো বৃষ্টির শক্তি। শক্ত কাঠের জানালার ওপাশে তখন বৃষ্টি ফোটার আছড়ে পড়ার মুহুর্মুহু শব্দ। সব কাজ ফেলে আমাদের চলতো প্রকৃতির তর্জন গর্জন উপভোগ। ঘরে ঘরে তখন সৃষ্টিকর্তার নিকট নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা।

মুহূর্তের মধ্যে ঘরের বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ হয়ে যেতো। গাঢ় অন্ধকার ঘরে সম্বল ছিল হারিকেন, কেরোসিনের বাতি বা কখনো মোমবাতি। উদ্যাম বাতাসে সে বাতির আলো আগলে রাখার অনর্থক চেষ্টা চলতো আমাদের। ঘরের মেঝে তখন ধুলায় কিচকিচ করতো। বিছানার চাদর, আলনার জামা-কাপড় কোন কিছুই রক্ষা পেতো না ধুলাবালি থেকে। ভয়ঙ্কর প্রকৃতি, ভয়ার্ত মানুষ ও ঘরহীন প্রাণী। পাখিবিহীন কালো আকাশ। অন্ধকার ঘর নামক ছোট্ট দূর্গে পরাজিত সৈন্যের মত চুপসে বসে থাকতাম আমরা ক’ভাই-বোন ও বাবা-মা।

আমাদের তিনতলা সরকারী কোয়াটারের পেছনেই কংক্রিটের প্রাচীরের ওপাশে চিকন খাল ঘেঁষে গড়ে উঠেছিলো বস্তি। ঝড়ের তাণ্ডবে বস্তির মাটি ও ছনের ঘর থেকে প্রবল বাতাসের মাঝে শোনা যেতো বিক্ষিপ্ত আর্তনাদ। কারো টিন উড়ে গিয়েছে, কারো মাথার উপরের ছন ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার। ঝড়ো বৃষ্টিতে কারো মাটির দেয়াল ঝাঝড়া হয়ে যাওয়া কোন দূর্গের মতো দেখাতো।

দোতলার বারান্দায় এসে অসহায় মানুষগুলোর প্রাণপণ ছুটোছুটি দেখতাম। সে কি তাদের অনর্থক চেষ্টা একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য। দৈত্যসমেত কালবৈশাখীর নিকট তারা নিজের সর্বস্ব প্রায় সমর্পণ করে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে।

চারদিকে তখন গাছের ডাল পড়ার দুম-দাম শব্দ। দুর্বল গাছ উপড়ে যেতো গোড়া থেকে। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাছের ডাল এদিকে সেদিকে ছিটকে পড়ছে। কোনটা আবার বন্ধ জানালার ওপাশে এসে আঘাত করতো। চমকে যেতাম সবাই। মস্ত পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এত ভয়ঙ্কর মুহূর্তের স্বাক্ষী হতাম শুধুই আমরা।

মাত্র এক ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা চলতো কালবৈশাখী ঝড়ের এই সাড়াশি অভিযান। পর মুহূর্তে ভেজা, শান্ত প্রকৃতি, চুপসে পড়া গাছ-পালা, লতা-পাতা—যেন কিছুই হয়নি প্রকৃতির। আমরা আতঙ্কিত মানুষেরা ঘর থেকে ছুটে ছুটে বের হয়ে আসতাম। চলে যেতাম আম গাছতলায়। ছোট-বড় ফাটা আম,যা পেতাম প্যান্টের পকেটে গুজে নিতাম।

রাস্তার ধারে উল্টে পাল্টে পড়ে থাকতো গাছপালার ডাল ও বিদ্যুতের খুঁটি। বন্ধ রাস্তা ও বিদ্যুৎ তখন মেরামতের জন্য অপেক্ষারত। বিদ্যুৎ কখন ফিরবে কেউ জানে না। হয়তো দুই ঘণ্টা বা দুই দিন। দুই ঘণ্টা পরে যদি বা বিদ্যুৎ আসতো, বিকট একটি শব্দে আবারও চলে যেতো। বুঝে যেতাম, ট্যানেসমিটার (ট্রান্সফরমার) বিষ্ফোরণ। বিদ্যুৎ তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতো দুই দিন বা তিন দিন পর।

লেখক: মাহবুব মানিক, বৈজ্ঞানিক গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, জার্মানি

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!