মায়ের কাছে জার্মান প্রবাসীর খোলা চিঠি

মা, তোমার ছেলে আর সেহরির সময় টের পায়না। শেষ রাতে কেউ হাত-পা ধরে টেনেও তোলে না।

মাহবুব মানিক, জার্মানির হালে থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2017, 03:41 AM
Updated : 3 Feb 2018, 11:22 AM

প্রায় দিনই আমার সেহরি না খেয়ে রোজা রাখতে হয়। জার্মানির এই গ্রীষ্মকালীন ঊনিশ ঘণ্টার দীর্ঘ সময়ের রোজায় শুকনো গলায় কষ্ট পেলে কেউ আদর করে বলে না, বেশি কষ্ট হচ্ছে? কষ্ট বেশি লাগলে রোজা ভেঙ্গে ফেল।

মোবাইলের এলার্ম আমাকে মাঝ রাতে ডেকে নিয়ে খাওয়াতে পারে না, দেশেও পারতো না। মাঝ রাতে হাত-পা টেনে কেউ আর বিছানা থেকে নামিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসায় না মা।

মনে পড়ে মা, মাঝে মাঝে আমি ঘুমের মধ্যে চোখ বন্ধ করেই তোমার সামনে বসে থাকতাম। আর তুমি ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে। আমি খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে গেলে সেই আধো খাওয়া এটো ভাতই থাকতো তোমার সেহরির আহার। তুমি হাতের তালুতে ঘষে সুন্দর করে ভাত মাখাতে পারতে। কী সুন্দর হলুদ তরকারির ঝোলে সাদা ভাতের রঙ মিলিয়ে যেতো, অথচ আমি এটা পারি না।

তুমি কি জানো মা, এখন আমি ঘরে কোমল পানীয় কিনে রাখি? যেসব আমি রান্না করি, সারাদিন রোজা রেখে এগুলো গলা দিয়ে নামাতে পারি না। অথচ তোমার রান্না সামান্য খারাপ হলে না খেয়ে থেকে তোমাকে কতো কষ্ট দিয়েছি! খাবার ঠাণ্ডা হলেও কষ্ট দিয়েছি। অথচ এই আমি আজ কাউকে কোন অভিযোগও করতে পারি না।

রোজার মাসে প্রায়ই রাত ১টা-দেড়টার দিকে ঘুম ভেঙ্গে যেত, আমার ঘর তখনো অন্ধকার থাকতো। পাশের ঘর পেরিয়ে একটু দূরেই ছিল আমাদের রান্নাঘর। আধো ঘুমে তখনো রান্নাঘর থেকে হাড়ি-পাতিলের ঠুকঠাক শব্দ শুনতে পেতাম। বুঝতে পারতাম, তুমি আমাদের সবার জন্য সেহরি রান্না করছো। তখনও তোমার কষ্টটা অনুভব করতে পারিনি। ভেবেছি, মা তো, মায়েরা এমনই হয়।

আমায় ক্ষমা করে দিও মা। বিশ্বাস করো আমি এখন সব বুঝি। মাঝ রাতে না ঘুমিয়ে পাতিল মাজা থেকে শুরু করে প্লেট মাজার কষ্ট। আমি সবই এখন টের পাই। তুমি জানো মা? প্রতিদিনই আমি ভাবি, কী রান্না করবো, কী খাবো? তুমি কীভাবে এতসব পারতে মা? আমাদের জন্য প্রতিদিনের খাবারের মেন্যু তুমি কীভাবে ঠিক করতে? কি সেই বৈচিত্র খাবারের মেন্যুতে! একবারও মনে হয়নি একই জিনিস বার বার খাচ্ছি।

মা, তুমি তো জানো আমি জার্মানিতে চাকরি করি। এখানে সপ্তাহে অফিস করি পাঁচ দিন আর বাকি দুই দিন ছুটি পাই। তুমি বিশ্বাস করবে না মা, ওই দুইটি দিন ছুটির জন্য আগ্রহ নিয়ে সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করি। কিন্তু তুমি তো ছুটি পেতে না মা! গরম পানিতে ছেঁকা লাগতো, তেল ছিটে তোমার হাত পুড়ে যেত। আমার মনে আছে তুমি পোড়া জায়গাতে চুন দিয়ে রাখতে, আমি তোমার দেখাদেখি কাটা জায়গাতে একদিন চুন দিয়েছিলাম। খুব যন্ত্রণা হয় মা, এটা খুব কষ্টের!

মনে আছে মা, আমরা ইফতারের সময় গোল হয়ে বসতাম। আমি, আব্বা আর দাদা বসতাম খাটের উপরে আর তুমি, মরিয়ম আপা, মলি আপা, হালিমা আপা মেঝেতে মাদুর পেতে বসতে। ইফতারের সময় আমি, আব্বা আর দাদার মাঝে বসতাম। তুমি চাইতে তোমার পাশে আমায় রাখতে। তোমার পাশে আমি কখনো বসতে চাইতাম না, তোমার শরীর থেকে কেমন যেন পেঁয়াজ আর মশলার গন্ধ আসতো। আমায় ক্ষমা করো মা, আমি পেঁয়াজের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না।

মাদুরের উপর থেকেই তুমি প্রতিদিন নিজে না খেয়ে তোমার পাতের খাবার হাত বাড়িয়ে আমার পাতে তুলে দিতে। আমি নির্লজ্জের মতো তোমার খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তুমি কেমন করে যেন বুঝে যেতে। আজ আমার ইফতারে নানা রকম ফলের জুস ও ফল থাকে। এসব দিয়ে ইফতার করে শরীরে হয়তো পুষ্টি পাই, কিন্তু মুখে লেগে থাকা পুরাতন স্বাদটা অধরাই থেকে যায়।

তুমি জানো মা, আমার দুই হাতে এখন পেঁয়াজের গন্ধ লেগে থাকে। কতবার হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে পরিষ্কার করি, গন্ধটা যেতেই চায় না। রান্নার পর শরীরের মশলার উটকো গন্ধ দূর করতে গোসল করতে হয়। মাথার চুল শক্ত হয়ে যায় তেল মশলার বাষ্পে। গায়ে পারফিউম ব্যবহার করতে হয়, অথচ তোমাকে কখনোই পারফিউম ব্যবহার করতে দেখিনি। বিরক্তিকর হাতের গন্ধ এড়ানোর জন্য রাবারের গ্লাভস পরে রান্না করতে হয়, অথচ তোমাকে কখনো রান্নার সময় বিরক্ত হতে দেখিনি।

মা, তোমার এখন বয়স হয়েছে, নানা রোগ হয়েছে। সবাই তোমাকে বৃদ্ধা বলে ডাকে। আমি বলি না মা, আমার সেই ছোটবেলার শক্ত সামর্থ্য মা-ই আছো আমার কাছে।

ছোটবেলায় রোজার দিনগুলোতে বাজার করা নিয়ে আব্বার মধ্যে যে চঞ্চলতা আমি দেখেছিলাম, তা আজ নিভে গেছে। এবার দেশে গিয়ে আব্বাকে দেখেছি সারাদিন জানালা দিয়ে বাইরে শূন্যে তাকিয়ে থাকতে, জানি না আব্বা আসলে শূন্যে কী দেখতো। হয়তো অতীতের রঙিন দিনগুলো ভাবতো। আব্বার সহায়ও এখন তুমি।

মা, তোমার বুকের হাহাকার আমি পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে এ শক্ত কংক্রিটের শহর থেকে টের পাই। তোমাকে মাঝ রাতে আর সেহরি রান্না করতে হয় না। বাসায় আজ আমরা কেউ নেই। শুধু তুমি, আব্বা আর মলি আপা। মা, তুমি নিরবে কাঁদো। আমি টের পাই। অনেক ভালো থেকো মা, অনেক ভালো।

লেখক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স,হালে, জার্মানি।

ইমেইল: mahbub_chkbd@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!