প্রবাসের চিঠি: জার্মান জীবনে শিষ্টাচার

আমি তখন জার্মানিতে নতুন এসেছি। শপিং মলের দরজা দিয়ে ঢুকবো। নতুন এসেছি, এদিক-সেদিক দেখছি আর অল্প অল্প করে এগুচ্ছি।

মাহবুব মানিক, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2017, 09:00 AM
Updated : 8 Oct 2017, 09:00 AM

হঠাৎ সামনে দেখি, এক ব্যক্তি আমার জন্য দরজার পাল্লা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ব্যাপারটা দেখে খুব বিব্রত বোধ করলাম। আমি ঢুকবো, তার জন্য উনি দরজার পাল্লা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, এটা কেমন কথা!

প্রথমে ভেবেছিলাম, উনি সম্ভবত গেটম্যান হবেন, অথবা মার্কেটের কর্মচারী। আমার ধারণা ভাঙলো যখন একটু এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকালাম। আন্তরিকতার পদ্ধতিটা দেখে আমি চমৎকৃত হলাম।

ধরা যাক, আপনি কোনো শপিং মলের দরজা দিয়ে ঢুকলেন। দেখবেন, আপনার আগে যে দরজা দিয়ে ঢুকবে সে আপনার জন্য দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। যতক্ষণ না আপনি দরজা অতিক্রম করবেন। আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে ‘ডাংকেশোন’ বা ‘ডাংকে’ বলে। এটাই এখানকার শিষ্টাচার। জবাবে ওই ব্যক্তিটিও আপনাকে বলবে ‘ইউ আর ওয়েলকাম’, জার্মান ভাষায় ‘বিট্টে’। এটাও শিষ্টাচার।

আবার একই কাজটি আপনার করতে হবে আপনার পেছনে যে থাকবে, তার জন্যে। এটাও শিষ্টাচার। প্রথম প্রথম হাস্যকর মনে হলেও পুরো ব্যাপারটাতে খুব মজা পেয়েছিলাম। আমি আমার জীবনে কোনো রিক্সাওয়ালাকে কখনও ধন্যবাদ জানাইনি। ইচ্ছা যে করতো না, তেমন না। তবে বলতে লজ্জা পেতাম। কারণ এই ধরনের প্রবণতা দেশে খুব একটা দেখা যায় না।

এবার বাংলাদেশে গিয়ে প্রায় দুই মাস ছিলাম। একজন মধ্যবয়সী রিক্সাচালককে দেখে সংকোচ কাটিয়ে তাকে সাহস করে একটা সালাম দিলাম। তিনি প্রথমে থতমত খেয়ে মুখের দিকে চেয়ে থেকে পরমুহূর্তেই সালামের উত্তর দিলেন। গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার পর তাকে ভাড়া মিটিয়ে বললাম, “ধন্যবাদ চাচা, ভালো থাকবেন।”

 তিনি খুব লজ্জা পেলেন। আমি তাকে বিদায় দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালে তিনি আমাকে ডাকলেন, “বাপজান শুনেন।” আমি ঘুরে তার সামনে দাঁড়ালে বললেন, “আপনি কী করেন?” আমি দেশের বাইরে থাকি, সেটা জানালাম।

ওনার চোখের কোণায় ততক্ষণে অল্প পানি জমে গেছে। বুঝলাম, হয়তো জীবনে এমন করে তার রিক্সায় চড়ে কেউ আমার মতো পাগলামি করেনি। সত্যি বলতে, আমাদের সমাজে শিষ্টাচার দেখানো এখন একটা পাগলামীর পর্যায়েই চলে গেছে। যখন দেখবেন কেউ সচরাচর এমন আচরণ করবে, সবাই তাকে পাগল ভেবে ঠাট্টা-তামাশা করবে। বন্ধু মহলে সে একজন ‘মফিজ’ বা ‘বলদ’ নামে পরিচিতি লাভ করবে।

যাই হোক, রিক্সাওয়ালা চাচা বললেন, “আপনি বাজান অনেক ভালো ঘরের সন্তান। দোয়া করি, আপনি অনেক বড় হন।” শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। পরিবারের গণ্ডির বাইরের কেউ সম্ভবত আমাকে এভাবে কখনও নিঃস্বার্থভাবে আশীর্বাদ করেনি।

বাসে করে লম্বা সফর করবেন। বাসের চালক নিরাপদে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন, বাস থেকে নেমে তাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন? একজন গরিব রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা থেকে নামার পর কখনও ধন্যবাদ দিয়েছেন? প্রশ্নই আসে না। তাই না? এটা তাদের দায়িত্ব। টাকা নিয়েছে, পৌঁছে দিয়েছে।

যদি রাস্তার ধারে খালে নিয়ে ফেলে দিতো? বেঁচে গেলে লোকজন জড়ো করে পিটিয়ে সোজা করে ফেলতাম। তবুও কৃতজ্ঞতা দেখানো সম্ভব না। দেওয়া-নেওয়া সম্পর্ক। টাকা দেব, জায়গা মতো পৌঁছে দিতে হবে। এর মাঝে কোনো মানবতা, সহমর্মিতা বা কৃতজ্ঞতা থাকতে পারে না, তাই না?

আসলে আমাদের দেশে এমন সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। অনেকের হয়তো ইচ্ছা করে, কিন্তু লজ্জা পায়। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে, সংকোচ কাটিয়ে বলতে পারে না। শিষ্টাচার জিনিসটা আসলে হঠাৎ করে মানুষ আয়ত্ত করতে পারে না। এর জন্য দরকার হয় দীর্ঘদিনের একটি সুস্থ পরিবেশ ও অভ্যাস।

শিষ্টাচার যেমন কেউ মায়ের পেট থেকে শেখে না, আবার প্রাপ্তবয়স্ক হবার পরেও হঠাৎ করে কেউ শিখতে পারে না। তবে শিষ্টাচারের অভ্যাসগুলো গড়ে তোলার শুরুটা হয় পরিবার থেকে। তারপর কিন্ডারগার্টেনে এরই ধারাবাহিকতায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পরিশেষে কর্মক্ষেত্রে।

জার্মানিতে আমি বাস করছি তিন বছরের বেশি। শুরু থেকেই দেখে এসেছি, জার্মানরা প্রতিটা কাজে বা প্রতিটা মুহূর্তে কীভাবে শিষ্টাচারের চর্চা করছে। একটি স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মানুষ, সবার মধ্যেই ব্যবহারগত আন্তরিকতার একটা সুস্থ চর্চা দেখতে পাই। আমি এদের এই অভ্যাসটা খুব উপভোগ করি।

দেশে শিষ্টাচারের এমন চর্চা থাকলে না জানি কি সুন্দর একটা পরিবেশ আমরা পেতাম! দেশে এমন মানুষও অনেক দেখেছি, একটা বাক্যের আগে-পিছে একটা গালি না বসিয়ে এরা বাক্য শেষ করতে পারে না। এভাবে নিজেরা যেমন অকারণে পাপে লিপ্ত হচ্ছে, আশপাশের মানুষগুলোও ভুক্তভোগী হচ্ছে। পরিশেষে সমাজটাই দূষিত হচ্ছে।

জার্মানিতে অপরিচিতদেরও আন্তরিকতার সাথে কিছু একটা সম্বোধন করতে হয়। ব্যাপারটা খুব মজার। ধরা যাক, আপনি একটা বিল্ডিংটাতে থাকেন। পাশের ফ্লাটে কে থাকে, আপনি তার নাম-ধাম-চেহারা কিছুই জানেন না। অথচ যখনই সিঁড়ি ঘরে বা লিফটের সামনে দেখতে পাবেন, তখন দু’জনের সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময় করাটা এখানকার শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে।

সকালে দেখা হলে দু’জনকেই বলতে হয় ‘গুটেন মর্গেন’ (গুড মর্নিং)। দিনের যে কোনও সময় দেখা হলে বলতে হয় ‘হ্যালো’ বা ‘গুটেন টাগ’ (গুড ডে)। আবার যে যার মত প্রস্থান করলে বলতে হয় ‘চুজ’ (বিদায়)।

সকালে দৌড়ে বাস স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাস স্টপেজে দাঁড়ালো। ড্রাইভার বাসের দরজা খুলে দিলো, ওঠার সময় ড্রাইভারের সঙ্গে কুশল বিনিময় করাটা শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে। এক্ষেত্রে দু’জন দু’জনকেই ‘হ্যালো’, ‘গুটেন মর্গেন’ বা ‘গুটেন টাগ’ বলে সম্বোধন করতে হয়। বাস থেকে নেমে যাবেন। যদি বাসের ড্রাইভারের পাশের দরজা দিয়ে নামেন, তখনও আপনার ড্রাইভারকে ‘ডাংকেশোন’ বা ‘চুজ’ বলে নামতে হবে। এটাও এখানকার শিষ্টাচার।

কর্মস্থলে যখন অফিস রুমের বাইরে করিডোর দিয়ে হাঁটি, যতবার সহকর্মীদের সাথে দেখা হয়, সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময় করতে হয়। তবে সময় ভেদে ‘গুটেন মর্গেন’, ‘গুটেন টাগ’ বা ‘মাল সাইট’ (খাবারের সময়) বলতে হয়। ‘মাল সাইট’ বলার সময়টাও নির্দিষ্ট। এটা বলতে হয় দুপুরের খাবারের সময়ের কাছাকাছি সময়টাতে। এটা বলার উদ্যেশ্য হলোম, দুপুরের আহার যাতে ভালো হয়, সেই শুভ কামনা করা।

কাউকে কিছু দিতে যাবেন, বা নেবেন- ধন্যবাদ জানানোটা শিষ্টাচার। ট্রেনে টিকেট চেকার আমাদের টিকেট চেক করার জন্য এলে ‘গুটেন টাগ’ (শুভ দিন) বলে তারপর টিকিট দেখাতে অনুরোধ করেন। তার বলার ভঙ্গিতে কোনো আদেশ থাকে না, থাকে অনুরোধ। টিকিট দেখা হলে হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানান। শুধু একবার-দু’বার নয়, প্রতিবারই এমনভাবে ব্যাপারটা হয়ে আসছে।

আমি কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের দেখেছি, তারা টেলিফোনে কথা বলার শুরুতে কীভাবে কুশল বিনিময় করে আর ফোন রাখার সময় শেষটা কীভাবে করে। তাদের কথার দৈর্ঘ যদি কয়েক সেকেন্ডের জন্যেও হয়, তাহলেও শুরুতে ‘গুটেন মর্গেন’, ‘গুটেন টাগ’ বা ‘হ্যালো’ থাকবে। আর রাখার সময় ‘শোনেন টাগ’ (সুন্দর দিনের প্রত্যাশী), যদি সপ্তাহের শেষ দিন হয় তখন বলে ‘শোনেন ভোখেনএন্ডে’ (সপ্তাহের ছুটির দিনগুলো সুন্দর যাক, এই কামনায়), অবশেষে ‘আউফ ভিদাজেহেন’ বা ‘চুজ’ (বিদায়) বলে।

যত ব্যস্ত-ই থাকুক, গড়গড় করে হলেও এই কথাগুলো বলবেই এরা। সুপার মার্কেটে বাজার করতে গেলেও দেখেছি, ক্যাশের ব্যস্ত কর্মীরা গড়গড় করে এই কথাগুলো বলবে। সে যতই ব্যস্ত থাকুক বা যতই ক্রেতার ভিড় লেগে থাকুক। প্রতিটা ক্রেতাকেই এভাবে সম্বোধন করবে। এর বিপরীতে আমাকেও অবশ্য তাকে বিদায় জানাতে হয়।

আমি এখানকার মানুষদের মুখে কোনো গালি জাতীয় শব্দ শুনিনি। এরা খুব বিরক্ত হলে ‘শাইছে’ (শিট) বলে ওঠে। এখানে বয়স, ধনী-গরিব বা সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে আন্তরিকতায় কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই সমান।

একবার ভাবুন তো, আমাদের দেশের মানুষগুলো যদি এভাবে প্রতিটা মানুষের সাথে এমন আন্তরিক হতো, সমাজে শিষ্টাচারের চর্চা হতো! কতো ভালোই না হতো তাহলে!

লেখক: মাহবুব মানিক, বৈজ্ঞানিক গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সাইন্স, জার্মানি

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!