জার্মানির প্রাচীন বৃক্ষ-বাগানের ইতিকথা

‘বৃক্ষ বাগান’ বা ‘বোটানিক্যাল গার্ডেন’-যে নামেই ডাকি না কেন, নামটি শুনলে চোখে ভাসে সবুজ ছায়াময় তরুর সমাহার।

মাহবুব মানিক, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2017, 03:42 AM
Updated : 6 Sept 2017, 03:42 AM

ইউরোপ মহাদেশে বোটানিক্যাল গার্ডেনের গোড়াপত্তন হয় মূলত ইতালির সালের্নোতে ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীতে ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় আরেকটি বোটানিক্যাল গার্ডেন উদ্বোধন করা হয় ইতালির বন্দর নগরী ভেনিসে।

অবশ্য সে সময়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলোতে বৃক্ষের সৌন্দর্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ঔষধি ও মশলার গাছ। অর্থাৎ ভেষজ গাছপালার আবাদকে লক্ষ্য রেখেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের সূচনা হয়। এছাড়াও রান্নার জন্য বিভিন্ন মশলার যোগানও আসতো বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে।

জার্মানির স্যাক্সনি আন হাল্টের অন্যতম একটি ছোট্ট শহর ‘হালে’ (জালে)।  ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ‘হালে’ নামটি এসেছে ব্রিথোনিক শব্দ ‘হালেন’ থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘লবণ’। হালে শহরটি শহর হিসেবে বেশ পুরাতন। হালে শহরের গোড়াপত্তন হয় মূলত ৮০৬ খ্রিস্টাব্দে। শহরটির সভ্যতা ‘জালে’ নামক নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

হালে শহরের স্থাপত্যগুলো যেমন পুরাতন তেমনি এই শহরের বোটানিক্যাল গার্ডেনটিও বেশ পুরাতন। হালেতে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সূচনা হয় মূলত ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে। তখন এটি ছিল ব্রান্ডেনবুর্গের যুবরাজ এলেক্টর ফ্রিডরিখ তৃতীয়-এর নিজস্ব সম্পত্তি। মূলত শখের বশেই তিনি বাগানটি করেছিলেন।

পরবর্তীতে তিনি এটিকে ‘ইউনিভার্সিটি অব হালে’র মেডিসিনাল ফ্যাকাল্টিকে দান করে যান। তখন ইউনিভার্সিটি অব হালের বয়স ছিল মাত্র চার বছর। যেটি ১৬৯৪ সালে সবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও কাছের শহর ভিটেনবার্গে এর থেকেও পুরাতন একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভালোই চলছিলো। শহরের নামেই যার নাম ছিল ‘ইউনিভার্সিটি অব ভিটেনবার্গ’। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে।

পরবর্তীতে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ইউনিভার্সিটি অব হালে’ ও ‘ইউনিভার্সিটি অব ভিটেনবার্গ’ একত্রিত হয়ে তৎকালীন ধর্মীয় সংস্কারবাদী খ্রিস্টান ধর্মযাজক মার্টিন লুথারের নামানুসারে নাম দেওয়া হয় ‘মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটি হালে-ভিটেনবার্গ’। হালে বোটানিক্যাল গার্ডেনটি এখন এই ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞান বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ একটি অন্যতম গবেষণাগার এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র।

‘হরটুস মেডিকাস’ বইয়ের বর্ণনানুযায়ী, প্রথমদিকে হালে বোটানিক্যাল গার্ডেনটি খুব একটা সফল ছিল না। নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। অন্যতম সমস্যা ছিল- অর্থায়নের অভাব, কূপের প্রয়োজনীয়তা, আশপাশের বেরসিক মানুষ ও গবাদী পশুর অত্যাচার। শহরটির পাশে জালে নদীটি ছিল লবণাক্ত। তাম্রযুগে এই নদীতে বাঁধ দিয়ে লবণ চাষ করা হতো।

যদিও প্রকৃতিগত অনেক পরিবর্তনের ফলে জালে নদীর পানি এখন সম্পূর্ণ মিঠা পানি। লবণ চাষ এখন শুধু হালে শহরের ইতিহাস মাত্র। বর্তমানে নদীর তীর ঘেঁষে একটি সল্ট মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে। মিউজিয়ামটির নামজালিনে মুজিয়ুম’।

১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে বোটানিক্যাল গার্ডেনটিতে মোটামুটি ১৯১ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালে হালে ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর কার্ল ক্রিসটোফ ফন হফম্যান বাগানের জায়গা বাড়ান। তিনি একজন বাগানপ্রেমী মানুষ ছিলেন। তার নিজস্ব বাগানটিও এই বোটানিক্যাল গার্ডেনটির সাথে সংযুক্ত করেন।

একই সময়ে বিখ্যাত প্রকৃতিবিজ্ঞানী জোহান রাইহোল্ড ফর্স্টার এবং ফিলিপ ক্যাসপার ইউংহান্স বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান। ওই সময়ে তাদের উদ্যোগে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও পর্যটক তাদের নতুন আবিষ্কৃত উদ্ভিদের প্রজাতি সেখানে নিয়ে গিয়ে রোপন করেন। বোটানিক্যাল গার্ডেনের গৌরব মূলত সেখান থেকেই শুরু।

বোটানিক্যাল গার্ডেনের সৌন্দর্য দেখার জন্য ১৭৮৮ সালে হালে শহরে একটি পর্যবেক্ষণ মিনার তৈরি করেন বিখ্যাত স্থপতি কার্ল গোথার্ড লাংহাম। লাংহাম মূলত বার্লিনের বিখ্যাত ব্রানডেনবুরগার ট্যুর নির্মাণশৈলীর জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত। তিনি অবশ্য পর্যবেক্ষণ মিনারটি একটু নতুন শৈলীতে নির্মাণ করেন। গোলাকার মিনারের উঁচু তলাতে চারপাশে চারটি বারান্দা যুক্ত করেন, যা আসলে চারটি দিক নির্দেশ করে।

ওই সময়ে হালে শহর নানাভাবে দূষিত ছিল, ফলে পর্যবেক্ষণ মিনার তৈরি সেখানে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। কারণ মিনার নির্মাণ কাজে নদী দূষিত হচ্ছিলো, যা ছিল বাগানের জন্য হুমকির কারণ। পরবর্তীতে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাগানের পরিচালক কুর্ট স্প্রেংগেলের আন্তরিক তত্ত্বাবধানে হালে বোটানিক্যাল গার্টেনের প্রাণ ফিরে পায়।

দিন দিন গাছের প্রজাতির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮০২ সালের ১১ জুলাই জোহান ফোলগাং ফন গোটে সেখানে ভ্রমণ করেন এবং গণনা করে দেখেন, সেখানে সাত হাজার প্রজাতির মতো উদ্ভিদ রয়েছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে গাছপালার প্রজাতির সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে ইউরোপ যেহেতু শীত প্রধান দেশ, তাই এখানে সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিল বিরূপ পরিবেশ। তখন পর্যন্ত বাগানের সংগ্রহে ছিল শুধুই শীতপ্রধান দেশের উদ্ভিদ প্রজাতি।

তবে নাতিশীতোষ্ণ বা গ্রীষ্মপ্রধান দেশের উদ্ভিদ সংগ্রহের উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৮০০ শতাব্দীতেই গ্রিন হাউজ বা কাচের ঘর নির্মাণ করা হয়। সফলভাবে গ্রীষ্মকালীন উদ্ভিদের জন্য গ্রিন হাউজ নির্মাণ করা হয় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে। এরই ধারাবাহিকতায় ভিক্টোরিয়া গ্রিন হাউজ তৈরি হয় ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের উন্নয়নের জন্য ১৯০০ সালে মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ‘ফ্রেন্ডস অব বোটানিক্যাল গার্ডেন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে।

এই সংগঠনের কাজ ছিল আর্থিকভাবে বাগানটিকে সাহায্য করা ও দেখভাল করা। এভাবেই যুগের পর যুগ হালে ইউনিভার্সিটির তত্ত্বাবধানে বোটানিক্যাল গার্ডেনটির উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৩১ সালে মাগদেবুর্গ সিটি হল গার্ডেনটিকে ‘প্রিন্স অব গার্ডেন’ সম্মানে ভূষিত করে।

বর্তমানে এই বোটানিক্যাল গার্ডেনের দায়িত্বে আছেন ‘মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটি হালে-ভিটেনবার্গ’-এর ‘ইন্সটিটিউট অব বোটানি’র ডিন অধ্যাপক ইজাবেল হেনজেন। এখানে বর্তমানে মোট জায়গার পরিমাণ সাড়ে চার হেক্টর। এর মধ্যে গ্রিন হাউজ চেম্বার আছে তিন হাজার স্কয়ার মিটার জুড়ে। ছোট-বড় মিলিয়ে গাছের প্রজাতির সংখ্যা এখন প্রায় ১২ হাজারের মতো। এখানে অত্যাধুনিক মানের বেশ কয়েকটি গ্রিন হাউজ চেম্বার আছে। এর মধ্যে অন্যতম ‘ভিক্টোরিয়া গ্রিন হাউজ’, যা ১৯৯৪ সালে শেষবারের মতো সংস্কার করা হয়।

মূলত গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোর জলজ উদ্ভিদ ও ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বৈজ্ঞানিক উপায়ে এখানে চাষাবাদ করা হয়। একটি গ্রিন হাউজ পরিপূর্ণ আছে শুধুই অর্কিড ও ক্যাকটাস দিয়ে। পৃথিবীতে যত প্রজাতির অর্কিড ও ক্যাকটাস আছে, তার প্রায় সবগুলো প্রজাতিই এখানে দেখতে পাবেন। সব থেকে মজার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সব উদ্ভিদই আপনি এই বোটানিক্যাল গার্ডেনে দেখতে পাবেন, যার সিংহভাগ চাষ করা হয় গ্রিন হাউজের মধ্যে।

যদি ফুলের কথায় আসি, তাহলে বলা যায় জাতীয় ফুল সাদা শাপলা থেকে শুরু করে লাল শাপলা, নীল শাপলা, পদ্ম ফুল, বিভিন্ন প্রজাতির গাঁদা, রঙ্গন, পাতা বাহার, গোলাপ, টগর, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা ইত্যাদি প্রজাতির ফুলের সমাহার দেখতে পাবেন এখানে। যদি ঔষধি বৃক্ষের কথায় আসা যায়, তাহলে বলা যায়- বহেরা, হরতকী, নিম, আমলকি, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ দেখতে পাবেন গ্রিন হাউজের মধ্যে।

বাংলাদেশের কিছু দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদও দেখতে পাবেন। যেমন- তুলসী, পাথরকুচি, ধুতুরা, আকন্দ, হস্তিশুণ্ড, সাদা লজ্জাবতী ইত্যাদি। ফলের মধ্যে কলা, আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা ইত্যাদিসহ অনেক দেশিয় ফলের গাছ দেখতে পাবেন। বাংলাদেশের পরিচিত সব সবজিই এখানে ছোট পরিসরে চাষ করা হয়। যেমন- লাউ, কুমড়া, করল্লা, উচ্ছে, শিম, পটল, চালকুমড়া, লেবু, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি।

কিছু প্রজাতির উদ্ভিদ একটি কি দুটি, আবার কিছু প্রজাতির উদ্ভিদ সারিবদ্ধ সাজানো। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ভিক্টোরিয়া গ্রিন হাউজের মধ্যে বাঁশের চাষ করা হয়। সম্পূর্ণ বাঁশের ঝাড় গ্রিন হাউজের মধ্যে। বুঝতেই পারছেন, গ্রিন হাউজের উচ্চতা কেমন হতে পারে। বাংলাদেশে যত প্রজাতির বাঁশ দেখা যায়, ঠিক ততো প্রজাতির বাঁশ চাষ করা হয় গ্রিন হাউজে।

সুন্দরবনে গিয়ে যে ম্যানগ্রোভ গাছ দেখেছেন, সেই গাছের মতোই স্বল্প পরিসরে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের সমাহার দেখতে পাবেন গ্রিন হাউজের মধ্যে। একটি ছোটখাটো বটগাছও রয়েছে গ্রিন হাউজের মধ্যে। এছাড়া রয়েছে আখ, মানকচু, কচুরিপানা, মস ফার্ন ও বিভিন্ন রকমের শ্যাওলাজাতীয় উদ্ভিদ।

লেখক: মাহবুব মানিক, বৈজ্ঞানিক গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সাইন্স, জার্মানি

তথ্যসূত্র: মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটি ওয়েবসাইট

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!