কালো রঙের কয়লার গুঁড়া কিনতাম পাঁচ পয়সা করে। কয়লার গুঁড়া কিনতাম ঠিক দাঁত মাজার জন্য নয়, কিনতাম মূলত খাওয়ার জন্য।ওই অদ্ভুত খাবার জিনিসটার নাম ছিল ‘হজমি’। বর্তমানের টেস্টি হজমির মত এমন টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদ ছিলনা, তবে এর কাছাকাছি এবং অনেক মজাদার ছিল। মুখে দিলেই স্বাদে মুখ বন্ধ হয়ে আসতো।
দশ পয়সা দিয়ে কিনতাম আচার। পলিথিনের প্যাকেটে পাতলা করে লেপ্টানো ছোট্ট গোল্লা পাকানো আচার। মাঝে মধ্যে ফ্রি’তে পোকা-টোকাও পেতাম! তবে অনেক সুস্বাদু আচার।
পঁচিশ পয়সা করে কিনতাম চকলেট। কমলার স্বাদযুক্ত চকলেট। চকলেটগুলো দেখতেও ছিল কমলার কোয়ার মতো। এক টাকায় চারটা চকলেট পাওয়া যেত। দোকানদার মাঝে মধ্যে খুশি হয়ে পাঁচটা চকলেটও দিয়ে দিতো।
জন্মের পর থেকে এক পয়সার মুদ্রা কখনোই কোনও দোকানে কাউকে লেনদেন করতে দেখিনি। তবে বইতে পড়েছি,কোনো এক কালে দেশে এক পয়সার মুদ্রার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন সময়ের ও ভিনদেশি ধাতব মুদ্রা সংগ্রহ করা আমার ছোটবেলার সখ। সেই সখের সংগ্রহের তালিকাতে প্রাচীন মুদ্রার পাশাপাশিএক পয়সার একটি তামার মুদ্রাও রয়েছে৷
বাংলাদেশে বহু আগেই পাঁচ-দশ পয়সার মুদ্রার গুরুত্ব হারিয়ে গেছে। বর্তমানে হারাতে বসেছে পঞ্চাশ পয়সা থেকে দুই টাকার সমপরিমাণ মুদ্রার মূল্য। আসলে আমাদের বাজার অব্যবস্থাপনার জন্যই এই মুদ্রাগুলো হারাতে বসেছি।
দেশে যখন ছিলাম, তখন চলছিলো মুদ্রার বদলে চকলেটের প্রচলন। আমরা যার ক্রেতা ছিলাম। আমরাও কোনদিন এর প্রতিবাদ করিনি। বিক্রেতার সাথে সুসম্পর্ক বা সামান্য এক টাকার জন্য অযাচিত ঝামেলা করতে অপারগতার জন্যই এক টাকার মুদ্রার বদলে চকলেট নির্দ্বিধায় নিয়ে নিতাম। যা পরবর্তীতে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে বসে।
প্রতিটা দোকানদার এখন চকলেট নিয়ে বসা শুরু করলো। বাচ্চা-শিশু থেকে বয়স্ক মানুষের হাতে এক টাকা ফেরতের পরিবর্তে একটা করে চকলেট ধরিয়ে দেওয়া শুরু হলো। এমনও না যে দেশে এক টাকার মুদ্রার বড় সংকট চলছিলো।
জার্মানিতে দেখেছি সাধারণত পঞ্চাশ সেন্টের নিচে কদাচিৎ কোনও কিছু তেমন কিনতে পাওয়া যায়না, শপিং ব্যাগ ছাড়া। তবে কম মূল্যমানের খাদ্যদ্রব্য, যেমন- ইস্টের (হেফে) দাম দশ সেন্ট ও এক রকম খাবার ক্রিমের কৌটার দাম ঊনত্রিশ সেন্ট। আটার কেজি বত্রিশ সেন্ট। এর বাইরে সব পণ্যের দাম-ই প্রায় এক ইউরোর উপরে বা কাছাকাছি।
জার্মানিতে ঠিক বাংলাদেশের মতই কম মূল্যমানের মুদ্রার দাম না থাকলেও কৌশল করে এই মুদ্রাগুলো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার সহযোগিতাতেই সিস্টেমটা চালু রয়েছে। এখানে লেনদেনের ক্ষেত্রে একটা একশ’ ইউরোর নোট যতটা গুরুত্ব বহন করে, ঠিক তেমনি একসেন্টের ছোট্ট একটা তামার মুদ্রাও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এদের বাজার ব্যবস্থাটাই এমন করে সাজানো।
আমরা যারা দোকানে মুদ্রার বিনিময়ে বাজার করি, সবাই ওয়ালেটের পাশাপাশি মুদ্রা রাখার থলে ব্যবহার করে থাকি। আবার কিছু ওয়ালেটে মুদ্রা রাখার জন্য আলাদা আবদ্ধ প্রকোষ্ঠ থাকে। আমরা মোটেই বিরক্ত হই না। বরং সিস্টেমটা উপভোগ করি।
কীভাবে এই ছোট্ট মুদ্রাগুলো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, এবার সে প্রসঙ্গে আসছি। প্রথমেই কিছু বিষয় জানিয়ে দিচ্ছি। এখানকার সুপারমার্কেটগুলোতে দামাদামি করার সুযোগ শূন্য। প্রতিটা পণ্যের মূল্য স্টিকার দিয়ে পণ্যের নিচেই আটকে দেওয়া থাকে। আবার এর মানে এই নয় যে, সুপারমার্কেটগুলো গলাকাটা দাম রাখে।
এখানকার ছোটখাটো দোকান থেকে সুপারমার্কেটে বাজার করা খুবই সাশ্রয়ী, অনেক রকম ছাড়ের ব্যবস্থাসহ তুলনামূলক কম মূল্য ধরা হয়। এছাড়া শতভাগ বিশ্বস্ত। আপনার যদি পণ্য পছন্দ না হয়, মেমো দেখিয়ে পণ্য ফেরত দিয়ে সমপরিমান টাকা উঠিয়ে নিতে পারবেন।পণ্য ফেরতের জন্য মোটামুটি চার সপ্তাহ সুযোগ থাকে।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসছি, কীভাবে এখানে ছোট্ট ও অচল মুদ্রাগুলো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
এখানকার প্রতিটি পণ্যের দাম ভগ্নাংশ দরে বিক্রি করা হয়। ধরা যাক, এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৬৯ সেন্ট, এক কেজি চিনির দাম ৬৫ সেন্ট, এক খাঁচি ডিমের দাম (দশটি ডিম) ১ ইউরো ৯ সেন্ট, এক লিটার তেলের দাম ৯৯ সেন্ট, এক কেজি সবজির দাম ১ ইউরো ২৯ সেন্ট, এক কেজি আটা ৩২ সেন্ট, একটি টিভির দাম ২০৫ ইউরো ৪১ সেন্ট। এখানে মাত্র কয়েকটি পণ্যের উদাহরণ টানা হয়েছে।
উপরের পণ্যগুলোর দামের সিস্টেম দেখেই সাধারণ জিনিসটা উপলব্ধি যায়। কেন দরদামের এই ভগ্ন দশা, তা সহজেই বোধগম্য। শুধুই অচল মুদ্রাগুলো বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনই উদ্দেশ্য নেই।পেঁয়াজের দাম ৭০ সেন্ট রাখলে নিশ্চয় কোনো ক্ষতি ছিল না। তারপরেও ৬৯ সেন্ট। যাতে করে একসেন্টের লেনদেন এক্ষেত্রে চালু থাকে। ঠিক একইভাবে অন্য পণ্যগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, মুদ্রার বদলে কোনো চকলেট এখানে চলে না। আবার মাত্র একসেন্ট ফেরত পাবো বলে কেউ বিক্রেতার কাছে ফেলেও রাখে না। বিক্রেতাও ওই এক-দুই সেন্ট মেরে দেবার ধান্দাতেও বসে থাকে না। আপনি ভুলে ফেলে যাবেন, পেছন থেকে ডেকে ডেকে আপনার হাতে এক সেন্ট ধরিয়ে দেবে।
কাল অথবা পরশু থেকে যদি বাংলাদেশে এই ব্যবস্থাটা চালু করা যেত, তাহলে হয়তো অচল পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সার মুদ্রাগুলো ফিরিয়ে আনা যেতো। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সুপারমার্কেটগুলো,সব জায়গাতেই যদি দামের এই ভগ্নাংশ চালু করা যেতো এবং জনসচেতনতা বাড়ানো যেত, তাহলে মুদ্রাগুলোর গুরুত্ব ফিরে আসতো।
ছোটবেলায় ফেলে আসা পাঁচ, দশ পয়সা দিয়ে কিছু কিনতে না পারি, অন্তত চোখের সামনেই থাকতো। লেনদেন করেও শান্তি পেতাম, আবার দেখেও শান্তি পেতাম।
লেখক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |