না ফেরার দেশে প্রিয় বাবার স্মৃতি

আমি যখন ২০১৪ সালে দেশ ছাড়ি, তখনো আব্বার মধ্যে বেশ চঞ্চলতা দেখেছিলাম। তিনি ছিলেন খুবই ছটফটে স্বভাবের একজন মানুষ।

মাহবুব মানিক, জার্মানির হালে থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2017, 07:45 AM
Updated : 14 June 2017, 07:45 AM

আব্বা আমাদের দুই ভাইকে ‘বাজান’ বলে ডাকতেন। বড় পরিবারে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্যপদ ছিল আমার, তাই আব্বা আমাকে ডাকতেন ‘কুটি বাজান’ বলে।

আমার এবং আব্বার মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল অনেক বেশি। সাধারণত এমন বয়সের পার্থক্য দৌহিত্র ও পিতামহের মধ্যে হয়ে থাকে। ছোটবেলার ঘটনা স্পষ্ট মনে পড়ে, আব্বার সাথে কোথাও যেতে খুব লজ্জা পেতাম। অনেকেই আমাদের পিতা-পুত্রের সম্পর্ককে ভুল বুঝে অন্য কিছু মন্তব্য করে বসতেন। তখন আব্বা লজ্জা পেয়ে বলতেন, না, এটা আমার ছোট ছেলে।

তাছাড়া অন্যদের বাবাদের দেখতাম, কালো কেশধারী মধ্যবয়সী আর আমি ছোটবেলাতেই দেখেছি আব্বার চুল এবং দাড়ি ছিল শ্বেতশুভ্র। এতে অবশ্য আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ ছিল না।

বড় পৃথিবীতে আব্বা ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে সেরা একজন ব্যক্তিত্ব। আব্বা তার সব সন্তানদের মধ্যে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। এটা ছিল আমার বিশ্বাস। হয়তো প্রতিটা সন্তান-ই এমন বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে।

সাতশ’ কোটি মানুষের পৃথিবীতে আমার আব্বার কাছে মাত্র দুইজন সেলিব্রেটি ছিলেন, সেই বিখ্যাত দুইজন হলো আমি নিজে এবং আমার বড় ভাই। তিনি আমাদের দু’জনকে পৃথিবীর সেরা বুদ্ধিমান এবং সর্বগুণে পারদর্শী ভাবতেন। কারো সাথে তিনি গল্পে বসলে তার গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রই থাকতাম আমি এবং আমার বড় ভাই। হোক সে গল্পের দৈর্ঘ্য দুই মিনিট কি তিন ঘণ্টার।

যদিও কোন গুণের বিন্দুমাত্র লক্ষ্মণ আমাদের দু’জনের মধ্যে কোনকালেই ছিল না। হয়তো এটাই বাস্তব, সব বাবাই তাদের সন্তানদেরকে গুণের দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে থাকেন। হোক না সে সন্ত্রাসীর বাবা, কিংবা রাষ্ট্রপতির বাবা।

গত ৪ জুন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ‘মায়ের কাছে জার্মান প্রবাসীর খোলা চিঠি’ শিরোনামে। লেখাটি ছিল চোখ বন্ধ করে একটা কল্পনাপ্রসূত লেখা, যা শৈশবে মা ও আমাদের সাথে ঘটেছিল। লেখাটিতে অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে ইমেইল করেছিলেন। বাস্তব জীবন বড়ই নিষ্ঠুর হয়। বাস্তবতা ছিল, দুই দিন পরে ছয় তারিখেই আমার আব্বা না ফেরার দেশে চলে যান।

আসলে মানুষের দীর্ঘ জীবনে সুখ ও দুঃখ ঠিক নদীর জোয়ার-ভাটার মতোই আসে-যায়। আজ আমি কাঁদছি, অন্য কেউ হয়তো হাসছে। আগামীকাল আমি হাসবো, তখন সে হয়তো কাঁদবে। এটাই হয়তো জীবন।

সকল সন্তানেরাই ছোটবেলাতে তাদের বাবা-মায়ের ব্যাপারে খুব আবেগপ্রবণ থাকে। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। ছোটবেলাতে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন নামাজ পড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে বারবার প্রার্থনা করতাম- আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর আগেই যেন আমি মারা যাই। সৃষ্টিকর্তা আমার প্রার্থনা রাখেননি। আমার আগেই আমার আব্বা চলে গেলেন।

জার্মানিতে বসে আব্বার মৃত্যুর সংবাদটা ছিল এখনো পর্যন্ত আমার জীবনের সবথেকে শক্ত হবার দিন। মাত্র দেড় মাস হলো আমি দেশ থেকে ঘুরে এসেছি। চাইলেই দেশে ফেরাটা ছিল অসম্ভব ছিল।

যেদিন আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যান, সেদিন আমার জার্মান ভিসা অফিসে একটা সাক্ষাৎ ছিল। আমি যখন বুকে অশ্রু লুকিয়ে সেখানে যাবার জন্য বের হয়ে ট্রামে উঠেছি, ঠিক ওই মুহূর্তে আমার বড় ভাই একটা ভিডিও কলে আব্বার নিথর দেহটা দেখাচ্ছিলেন।

যে আব্বার মাঝে আমি সারাজীবন চঞ্চলতা দেখেছিলাম, হুমকি-ধমকি দেখেছিলাম, সেই আব্বার সাদা কাপড়ে মোড়ানো স্থির মুখটা দেখে মানুষের ভিড়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। বুকের কান্না উগড়ে দিয়ে সবার সামনেই চিৎকার করে কান্না করেছিলাম। সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। পুরোটা পথ কাঁদতে কাঁদতে গিয়েছি। এখনো আব্বার স্থির মুখটা চোখে ভাসলেই চোখ আমার ভিজে যায়।

আব্বার বুকের এক্স-রে রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেছিলেন, আব্বার হার্ট (হৃদয়) স্বাভাবিকের চেয়ে আকারে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। যদিও এটা ছিল তার অসুখ, তবুও বাস্তবে আব্বার হৃদয়টা সাগরের মতই বিশাল ছিল। মানুষের প্রতি সৌজন্যতা ও ভালোবাসাটা আব্বাই আমাদের শিখিয়েছিলেন। আজো মানুষের ভলোবাসা নিয়েই বেঁচে আছি।

আব্বা খুব পান খেতেন। তার ঠোঁটের কোণায় সব সময় লাল পানের পিকে ভেজা থাকতো। সাদা দাড়িতেও পানের পিক মেখে থাকতো। এই জন্য মাকে দেখতাম, আব্বার সাথে খুব রাগারাগি করতেন। আব্বার ঢোলা পাঞ্জাবীর বুকের কাছেও জায়গায় জায়গায় সব সময় পানের পিকের লাল দাগ মেখে থাকতো। মা সব সময় সেই লাল দাগে চুন দিয়ে সাদা বানানোর বৃথা চেষ্টা করতেন।

 মা বলতেন, চুন দিলে দাগ মিলিয়ে যায়। যদিও আমি কখনো লাল দাগ মিলে যেতে দেখিনি। আব্বার চেহারা যখন চোখে ভাসে, তখন লাল পানের পিকে ভেজা ঠোঁট, বুকের কাছে পানের পিকের লাল দাগটাও বাদ যায় না। আব্বার শিওরের জানালার চৌকাঠ ও ভেজা পানের পিকে লাল হয়ে থাকতো। চৌকাঠ এখনো লাল হয়েই আছে, শুধু আব্বা চলে গেছেন।

আব্বার মূলত শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। আব্বার ঘরটাকেই আমি ও আমার বড় ভাই হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছিলাম। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ-পত্র থেকে শুরু করে অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজার মেশিনসহ স্টেথিস্কোপ এবং প্রেশার মাপার মেশিন সব প্রস্তুত থাকতো।

শীতকালের তিনটা মাস মূলত আব্বার জন্য কঠিনতম মাস ছিল। আমরা যারা বাসায় থাকতাম, আব্বা সবাইকে সারারাত জাগিয়ে রাখতেন। প্রচণ্ড কষ্ট পেতেন শ্বাসকষ্টে। মাঝে মাঝে অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালেও নেওয়া হতো। গরমের দিনগুলোতে তিনি ভালোই ছিলেন। আসছে শীতে শ্বাসকষ্টের বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধ করবেন, তার একটা মানসিক প্রস্তুতিও হয়তো নিচ্ছিলেন। সব দুঃশ্চিন্তা কাটিয়ে সৃষ্টিকর্তা রোজার মাসেই নিজের কাছে ডেকে নিলেন।

আব্বা যখন সুস্থ ছিলেন, তখন সবার সাথেই তিনি ধমক দিয়ে কথা বলতেন। সব সময় হুমকি-ধমকি টাইপের কথা বলার একটা ঝোঁক ছিল। হয়তো পৃথিবীর সকল বাবার-ই এটা একটা স্ব-প্রবণতা। সময়ের সাথে বয়সের ভারে তার হুমকি-ধমকিও হারিয়ে যেতে থাকে।

বিদেশ থেকে মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতাম,  “আব্বা কি আজকে কাউকে ধমক দিয়েছেন?” যদি মা বলতেন, “না, সে চুপ করে বসে থাকে, কিচ্ছু খাইতে চায় না।” তখন খুব দুঃশ্চিন্তা হতো, ভয় পেয়ে যেতাম। আবার অনেক সময় মা নিজেই ফোন করে আব্বার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন,  “তোর আব্বা আজকে ঘরে তাণ্ডব বাঁধিয়ে বসেছে। আমাকে ধমক দিয়েছে। একে ধমক দিয়েছে, তাকে বকা দিয়েছে।”

মায়ের কাছে আব্বার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে মন খারাপ করার অভিনয় করে মাকে সান্তনা দিতাম ঠিকই,  কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে চিৎকার করে বলতাম- যাক, আমার আব্বা যথেষ্ট সুস্থ আছেন।

আব্বা চলে যাবার পর দেশে-বিদেশে অনেকেই সান্তনা দিয়েছেন বা দেবার চেষ্টা করেছেন। যদিও তারা ভালো করেই জানেন, এ সান্তনা দেবার মত নয়। কথায় আছে- ‘যার চলে যায়, সেই বোঝে হায়, বিচ্ছেদের কি যন্ত্রণা’। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আসলে যার যায়, সেই বোঝে।

আশাহত হইনি, মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই একদিন হয়তো আব্বার সাথে দেখা হবে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়। তখন থাকবে না আমার-আব্বার বয়সের ব্যবধান, থাকবে না কোন দূরত্বের ব্যবধান। থাকবে না আব্বার শ্বাসকষ্ট, থাকবে না আব্বার অক্সিজেন সিলিন্ডার। থাকবে না আব্বার ঔষধের বাক্স, থাকবে না পাঞ্জাবিতে পানের পিকের লাল দাগ।

হাস্যমান ঠোঁটের কোণেও থাকবে না কোনো পানের পিকের লাল দাগ। একই ঘরে নয়তো প্রতিবেশী হবো আমি আর আব্বা। আব্বা, তোমায় যে অনেক বেশি ভালোবাসি।

লেখক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স,হালে, জার্মানি।

ইমেইল: mahbub_chkbd@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন