প্রবাসের চিঠি: প্রিয় অসৎ মানুষেরা!

এখন রোজার মাস চলছে। মাত্র কয়টা দিন পর পবিত্র ঈদুল ফিতর৷ ঈদকে সামনে রেখে সবারই খরচ অনেক বেড়ে গেছে ৷

মাহবুব মানিক, জার্মানির হালে থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 June 2017, 10:33 AM
Updated : 18 June 2017, 01:15 PM

পরিবারের প্রিয় মুখগুলো উন্মুখ হয়ে আছে ঈদে নতুন পোশাক বা নতুন কোন উপহারের জন্য৷ঈদের মতো একটা পবিত্র ধর্মীয় ইমেজকে কাজে লাগিয়ে অসহায় ধার্মিক মানুষগুলোর সাথে নিত্যদিন ছিনিমিনি খেলছে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের অসাধু মানুষগুলো৷প্রিয় অসৎ মানুষেরা, আপনাদের কাছেই এই খোলা চিঠি-

প্রিয় ব্যবসায়ী, সামনে আসছে ঈদ৷এটাই আপনার টাকা বানাবার মৌসুম৷আপনি সারা বছর চেয়ে থাকেন দুটি ঈদের দিকে৷আপনি ধার্মিক? হজও করে আসছেন৷কয়বার হজ করে আসছেন? তিনবার!এই মজুদ করে রাখা ছোলা, পেঁয়াজ, চিনি, মশলা, চাল ইত্যাদি ঈদের আগে দাম পাঁচগুন বাড়িয়ে সেই টাকা দিয়ে হজ করে আসছেন! আপনি ধার্মিক বটে৷ আপনি কি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেনসৃষ্টিকর্তা আপনার হজ কবুল করেছেন!

নিজের মনে হয়তো বলছেন, তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা৷ লোকে আমাকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বলে, হাজি সাহেব বলে, নামের আগে আলহাজ বসিয়ে রেখেছি৷ এটাই বড় সম্মানের, এটাই আমার ব্যবসার পুঁজি৷ শবে বরাত আর শবে কদরের রাততো আছেই, সারারাত কান্নাকাটি করে, আমি পাপমুক্ত হয়ে যাবো৷ আপনি অপেক্ষা করতে থাকেন পাপ মোচনের৷ সৃষ্টকর্তাকে আপনি আপনার খরিদ্দারের মতো অসহায় ও বোকা মনে করেন৷ তাইনা?

আপনি মশলার মধ্যে ইটের গুড়া, কাঠের গুড়া মেশান, দুধের মধ্যে পানি মেশান, মরা গরু মাংস বানিয়ে বিক্রি করে দেন, কুকুরের মাংসকে গরুর মাংস বলে বিক্রি করেন৷ ভেজাল সাবান শ্যাম্পুর কারখানা আপনার৷ হোটেলে মরে পঁচে যাওয়া মুরগী গ্রিল বানিয়ে মানুষকে খাওয়াচ্ছেন৷ সেমাই কারখানায় ভেজাল সেমাই বানাচ্ছেন৷ ঈদে আপনার পরিবারের জন্য অনেক খরচ আছে বলে সব কিছুর দাম বাড়িয়ে ধরছেন৷ আসছে ঈদকে উপলক্ষ্য করে আপনার ব্যবসার অবৈধ কার্যক্রমও চলছে জোর কদমে৷

এসব দুই নাম্বারি করে এই ঈদেই আবার চকচকে সাদা পাঞ্জাবিপরে ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন৷ কি চমৎকার তাইনা? লজ্জা করছেনা? লজ্জা থাকলে কি আর বড়লোক হওয়া যায়। সুবিচার পাবেন, আজ অথবা কাল, নয়তো দশ বছর পর৷ কর্মফল সবাই ভোগ করে৷

প্রিয় সরকারি কর্মকর্তা, আসছে ঈদ উপলক্ষ্যে আপনার পরিবারের জন্যে অনেক খরচ আছে৷ পরিবারের সবার জন্য নতুন কাপড় চাই৷ দেশের সরকার বা আপনার অফিসের মালিক কিন্তু ঈদ উপলক্ষ্যে আপনার খরচের ব্যাপারটা জানে৷ আপনার খরচের যোগত্যার মাপকাঠিও তারা জানে৷ তারা কিন্তু আপনাকে ঠকায়নি৷ ঈদ বোনাস পেয়েছেন তো? যদি পেয়েই থাকেন তাহলে কেন আপনার অফিসে যেসব সাধারণ মানুষ কাজের জন্য আসে তাদেরকে পবিত্র ঈদের উপলক্ষ্য দেখিয়ে অতিরিক্ত কিছু টাকা পকেটে ঢোকান?

প্রিয় পোশাকধারী ভিক্ষুক, নীল পোশাকে বড় রাস্তার ধারে ও বড় রাস্তার মোড়ে আপনাদের বিচরণ৷ রোদ, বৃষ্টির মধ্যে আপনাদের কাজের কোন বিরতি নেই৷ বুঝি অনেক কষ্ট করেন৷ অনেক কষ্ট করে তবে আপনারা সরকার থেকে বেতন পান৷ কষ্ট হবে জেনেই কিন্তু এপথে এসেছিলেন, এ পেশাতে নাম লিখিয়েছিলেন৷ নাকি তলে তলে অন্য কোন ইচ্ছা মনে পোষণ করে এসেছিলেন?

আসছে ঈদে উপার্জনের মিশনে আপনারাও পিছিয়ে নেই৷ যানবহন থামিয়ে দশ টাকা থেকে শুরু করে হাজার হাজার টাকা চেয়ে চেয়ে নেন৷ কেউ নিশ্চয় স্বেচ্ছায় দেয় না৷ কষ্টার্জিত টাকা কেউ নিজ থেকে দিতে চায়! জোর করে বা ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়া তো এক রকম জুলুম৷ এ টাকা দিয়ে আপনি হয়তো ঈদে ফ্লাট কিনবেন, জমি কিনবেন, বউ, ছেলে-মেয়েদের বায়না মেটাবেন৷

কতোদিন আর বাঁচবেন বলুন? এখন আপনার বয়স পঞ্চাশ, গড় আয়ু ধরলে আর দশ বছর হাতে আছে আপনার৷ আপনার ওই উৎকোচের টাকায় যে মানুষের অভিশাপ, ঘেন্না লেগে আছে৷ আপনার কি মনে হয় না? এটা অদৃশ্যভাবে আপনার খাবারে মিশে খাবার বিষাক্ত করছে? আপনি অদৃশ্য কিছুতে বিশ্বাস করেন না? তার মানে বাতাসে আপনার বিশ্বাস নেই, বাতাসের মধ্যে ভেসে বেড়ানো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াতেও আপনার বিশ্বাস নেই৷

প্রিয় ছিনতাইকারী, এটা আপনার পেশা৷মার্কেট, রাস্তা, ফেরিঘাট, রেলস্টেশন বা বাস-টার্মিনালেরনিরীহ মানুষের অসচেতনতা ও দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়েতাদের পকেটের টাকা, মোবাইল ও দামি জিনিস জোর করে কেড়ে নিয়ে সেই টাকা দিয়ে আপনার বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের দেখভাল করেন৷আপনার প্রিয় মুখগুলোর হাসি ফুটিয়ে তোলেন৷

আপনি কি ধর্ম বিশ্বাস করেন? করেন, তাই তো? আপনি জুম্মার দিনে সন্তানকে ছোট্ট পাঞ্জাবি ও টুপি পরিয়ে হাত ধরে মসজিদে যান৷ বৃদ্ধ বাবাকে কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে পৌঁছে দেন৷ আপনি ধার্মিক৷ তাইনা? আপনি চোখ বন্ধ করে পাঁচটা মিনিট ভাবুন৷ আপনি কি আসলেই ধার্মিক? আচ্ছা আপনার ধর্ম নাই, আপনি ধর্মটা পাশে রাখেন৷ আপনি তো একজন মানুষ৷ তারমানে আপনার মধ্যে মানবতা আছে৷

আবার একটু দয়া করে চোখ দুটো বন্ধ করে কিছু আর্তনাদ শোনার চেষ্টা করুনতো৷ যাদের কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস কেড়ে নিলেন, তাদেরওতো আপনার মতো স্বপ্ন ছিল, তাদের পরিবার ছিল, তাদের সন্তানদের প্রতিও স্নেহ-মমতা ছিল৷ তারা আপনাকে স্বেচ্ছায় কিছু দিতে চায়নি, কারণ তাদের কাছে স্বেচ্ছায় দেবার মতো অতিরিক্ত সম্পদ ছিলোনা৷ তাই বলে আপনি তাদের বুকে, কাধে, পিঠে, কোমরে ছুরি দিয়ে গর্ত করে দিলেন?

আপনার কর্মফল, আপনাকে, আপনার স্ত্রীকে অথবা আপনার সন্তানকে ভোগ করতে হবে৷ এটা প্রাকৃতিক, জাগতিক, সৃষ্টিকর্তার দেওয়া৷ আপনি বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই এটা হয়ে আসছে৷ একবার ভাবুনতো বিনাঅপরাধে কেউ আপনার নিস্পাপ মায়ের হাতের কব্জি আলাদা করে দিলো, অথবা আপনার সন্তানের আঙ্গুল কেটে দিলো৷ কষ্ট হচ্ছে না? কষ্ট পাচ্ছেন? এমন কষ্ট ওই মানুষগুলোও পাচ্ছে৷

প্রিয় চাঁদাবাজ, সারাবছর আপনি নির্দিষ্ট একটা দলের ট্যাগ লাগিয়ে নানান রকম অজুহাত ও ভয়ভীতি দেখিয়ে স্থানীয় বাসাবাড়ি, নির্মানাধীন বাসা-বাড়ি, দোকানপাট, ভ্যান-রিক্সা-সিএনজি ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে চাঁদা তুলে বেড়ান৷ ঈদের আগে আপনার চাঁদার রেট বেড়ে যায়, পরিধিও বেড়ে যায়৷

এই টাকা দিয়ে হয়তো আপনি আসছে ঈদ উপলক্ষ্যে বউকে নতুন একটা ফ্লাট উপহার দিবেন৷নতুন জায়গার বায়না করবেন৷ নতুন মডেলের গাড়ি কিনবেন৷ জাগতিক দুঃখ-কষ্ট, অভিশাপ এগুলা বিশ্বাস করেন? এসব চিন্তা করার সময় আপনার নেই৷ তাইতো? আপনি কি মনে করেনসৃষ্টিকর্তানিপীড়িত মানুষের সাথে নেই? অবশ্যই আছেন৷ আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, জাগতিক নিয়মের বাইরে কিছুই হয়না৷

প্রিয় মৌসুমি ধান্দাবাজ, আপনার নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই৷ ধান্দা করেই আপনার পেট চলে৷ সৃষ্টিকর্তার দেওয়ামস্তিষ্ক দিয়ে ধান্দা করে খান, কি দুর্ভাগ্য আপনার! পবিত্র ঈদ উপলক্ষ্যে নিত্য নতুন ধান্দা আবিষ্কার করে চলেছেন৷ হায়রে পোড়া কপাল, এমন ক্ষীপ্র মস্তিষ্ক ভালো কাজে লাগছেনা, পুরোটাই ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছেন৷কখনো মলমপার্টি, ওয়েলকাম পার্টি, আবার কখনো জ্বিনের বাদশা সেজে ধোঁকা দিয়ে টাকা রোজগার করেন৷

সেই টাকা দিয়ে আপনার সংসার চলে৷ মা, বাবা, বউ, বাচ্চা সবার রক্ত আপনার এ দুর্গন্ধময় টাকার নির্যাস বয়ে বেড়াচ্ছে৷ আপনার জন্য অনেক মানুষ সর্বশান্ত হচ্ছে, কষ্টের সম্পদ হারাচ্ছে, চিৎকারকরে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে, আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছে।

লেখক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি৷

ইমেইল: mahbub_chkbd@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!