যত দূরে থাকে প্রিয়া, ততো কাছে রাখে তারে হিয়া

আজ রোববার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকাল ৭টায় ঘুম ভেঙ্গে ফোনের স্ক্রিনটা অন করেই প্রতিদিনের মত করে একটি পরিচিত মুখের ছবি দেখি, সাথে প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র একটি চিঠি ‘গুড মর্নিং’।

মাহবুব মানিক, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2017, 06:54 AM
Updated : 23 May 2017, 06:54 AM

প্রিয় মুখটির সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র দুই মাসের। অথচ অনুভব করি, তার সাথে যেন আমার পরিচয় বহু যুগের। সকালে উঠে ঘুম ঘুম চোখেই তার একটি ছবি, সাথে ‘গুড মর্নিং’ লেখা একটি বার্তা। সাথে থাকে দুঃখের কিছু ইমো বা স্টিকার। এটি ছিল রিপার প্রতিদিনের রূটিন।

রিপার ওখানে যখন সকাল, আমার তখন মাঝ রাত। যদিও সকালে উঠেই রিপার ঘুমে ক্লান্ত মুখটি দেখে শান্তি পাই। রিপার পাঠানো ইমোতে দেখা যায়, হলুদ গোল মুখের গোল গোল চোখ ভর্তি পানি। আর স্টিকারে ছোট একটি ফ্রক পড়া মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, বৃষ্টির পানিতে তার চোখের পানি হারিয়ে যাচ্ছে।

রিপা খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে, সামান্য দুটো ইমো আর স্টিকারে তার দুঃখ-কষ্টের সবটুকু অনুভূতি আমায় জানিয়ে দিতো। আমি পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে অসহায়ের মত বুকে পাথর বেঁধে সেই ভারী কষ্ট-দুঃখগুলা বুকে লেপ্টে রিপার অজান্তেই তার কষ্ট-দুঃখ হালকা করার চেষ্টা করতাম।

আমার ও রিপার সময়ের ব্যবধান চার ঘণ্টা। কর্ম দিবসের ব্যস্ত দিনগুলোতে ঘুম ভেঙ্গে রিপার মুখটি দেখার ফুরসৎও অনেক সময় হয়ে ওঠে না। লাফিয়ে-ঝাপিয়ে অফিসে যাবার তাড়া থাকে। তবুও ভালো লাগে মোবাইল স্ক্রিনে যতক্ষণ রিপার ছবিটি তাজা ফুলের মত ফুটে থাকে।

দূরের ভালোবাসাগুলো খুব অদ্ভুত হয়। সব সময় এক ধরনের অভিমানের প্রতিযোগিতা। যে যত অভিমান করতে পারে, সে তত বেশি ভালেবাসা পায়। পৃথিবীতে সব মানুষই ভালোবাসা পেতে চায়, আমি ও রিপা এর ব্যতিক্রম নই।  দু’জনই কিছু একটা নিয়ে ঐচ্ছিক ঝামেলা বাঁধিয়ে অভিমান করে ফোনের কাছে একটি ম্যাসেজ অথবা ফোন কলের অপেক্ষার প্রহর গুণি।

অভিমানের প্রতিযোগিতায় আমি সব সময়ই হেরে যেতাম। নিজেকে হারিয়ে রিপাকে জিতিয়ে দিতাম। রিপা খুব খুশি হতো। রিপার হাসি মুখটি আমি মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে স্বর্গীয় শান্তি পেতাম।

কোন এক রাতে আভিমানের প্রতিযোগিতায় আমি জিতে রিপাকে হারিয়ে দিয়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে রিপাকে ফোন দিয়ে শুনি, সে রাত থেকেই প্রচণ্ড অসুস্থ। প্রচণ্ড বিচলিত মন নিয়ে সেদিন-ই শপথ করেছিলাম, রিপাকে আমি হারতে দেব না। আর হারতে দিইনি।

আজকে আমার আকাশে অনেক মেঘ, কালো ঘন মেঘ। দানবের মত পুরো আকাশটা ঢেকে রেখেছে কুচকুচে কালো ঘন মেঘ। থেকে থেকে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির এক ভয়ংকর রূপ। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামবে। ভারী ভারী বৃষ্টির ফোটা।

রিপার সঙ্গে আমার সংসার ছিল মাত্র এক মাসের। দেশে থাকতে খুব ইচ্ছা ছিল, রিপার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো। ঝম ঝম বৃষ্টিতে বাসার ছাদে রিপা আর আমি ভিজবো, কাক ভেজা ভিজবো। বিদ্যুতের চমকে বাসার ছাদের ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নেব। ভয়ার্ত ও রোমাঞ্চকর মুহূর্তের সাথে ঝড়ো বাতাসে বৃষ্টিতে ভেজার তালে তালে চলবে একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত-

“মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো

দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।।

হৃদয় ও গগনে সজলও ঘন

নবীনও মেঘে রসেরও ধারা বরষে

মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো

দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।

তাহারে দেখি না যে দেখি না

শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ঐ শোনা যায়

বাজে অলকিত তার চরণে।”

আমাদের বৃষ্টি বিলাস নিষ্ফল হয়েছিল। রিপার সাথে আমার বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। দেশে থাকতে তখন তেমন একটা বৃষ্টি হয়নি। এক রকমের মানসিক কষ্ট নিয়েই দেশে ছেড়েছিলাম। কবে রিপার সাথে বৃষ্টি স্নান করবো!  রিপা বা আমি, কেউ জানি না।

হালে শহরের পাঁচতলা কংক্রিটের বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে, কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে রিপার কথা ভাবছি। আমার দৃষ্টি তখন শূন্যে। রিপার আকাশেও কি কালো মেঘ করেছে? রিপাও কি আমার কথা ভাবছে?

মুহূর্তটা জীবনের সেরা একটি রোমান্টিক মুহূর্ত মনে হচ্ছিলো। আসলে প্রকৃতির অলৌকিক কিছু ক্ষমতা রয়েছে যে ক্ষমতায় প্রকৃতি মানুষের মনের কষ্ট-দুঃখ ভাসিয়ে দিয়ে জীবনের সব হিসাব ওলোট-পালট করে দিতে পারে ৷ মুহূর্তটি ঠিক তেমনি মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে আমি-ই একজন মানুষ, যার জীবনে কোন কষ্ট নেই।

রিপাকে আজ পাশে পেলে খুব ভালো হতো। প্রকৃতির সাথে মনের আনন্দ দু’জন ভাগাভাগি করে নিতাম। জানালার চৌকাঠে হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে দু’জনে দুই মগ ভর্তি দুধ চায়ে চুমুক দিয়ে কালো মেঘের আকাশ দেখতাম। কালো মেঘের নিচে ভয়ংকর প্রকৃতি দেখতাম।

রিপা বলতো, প্রকৃতির এই মুহূর্তগুলো সে খুব উপভোগ করে। যদিও বাস্তবে তা দেখার সুযোগ আমার কখনো হয়নি। রিপাকে পাশে নিয়ে কালো মেঘে ঢাকা আকাশ, বিদ্যুতের ঝলকানি, থেকে থেকে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ, ঝম ঝম বৃষ্টি- খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।

রিপা আমার পাশে নেই। রিপাকে ফোন করলাম, রিপা ফোনটি রিসিভ করেই আমার সুন্দর মুহূর্তে নিমিষে বজ্রপাত করেই বললো- বাসায় বিদ্যুৎ নেই, খুব গরম পড়েছে, গরমে খুব কষ্ট হচ্ছে। বাইরে প্রচণ্ড রোদ। তখন অজান্তেই মনে পড়লো, সময় আর দূরত্বের ব্যবধানের কথা। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, রিপা আমার থেকে চার ঘণ্টা এগিয়ে, আমার থেকে রিপা পাঁচ হাজার মাইল দূরে।

আমার আকাশে মেঘ। কুচ কুচে ঘন কালো মেঘ আর রিপার আকাশে রোদ। ঝকঝকে সোনালী রোদ। তাতে কী? হোক না সময় আর দূরত্বের ব্যবধান, হোক না প্রকৃতির আচরণে বিস্তর ব্যবধান, রিপা তো আমার হীয়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে।

সাদা-কালো জীবনে এখন শুধুই অপেক্ষা। রংধনুর অপেক্ষা। পরবর্তী ঝম ঝম বৃষ্টির অপেক্ষা। রিপার সাথে বৃষ্টি বিলাসের অপেক্ষা।

লেখক:সাইন্টিফিক রিসার্চার, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সাইন্স, হালে, জার্মানি।

ইমেইল: mahbub_chkbd@yahoo.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!