যুক্তরাষ্ট্রে শীত উৎসব

আমেরিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে তিন মাস শীতকাল হলেও এর স্থায়ীত্ব আরও বেশি মনে হয়। শেষই হতে চায় না।

আশরাফুন নাহার লিউজা, নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2017, 03:00 AM
Updated : 29 Dec 2017, 03:00 AM

বিশেষত শরতের শেষের দিক থেকেই ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে। আর তা চলতে থাকে বসন্তকালের অনেকটা জুড়েই। তবে বসন্তকালে গাছে গাছে যখন নতুন পাতা আর ফুল উঁকি দিতে থাকে, তখন প্রকৃতি রীতিমতো হেসে ওঠে আপন খেয়ালে। শুরু হয় জীবনের অন্যরকম জয়গান।

গ্রীষ্মকাল রীতিমতো স্বর্গ হয়ে আসে এদেশের প্রকৃতিতে। মানুষ বের হয়ে আসে বাইরে। প্রকৃতিই হয়ে ওঠে তাদের আশ্রয়। প্রকৃতির নিবিড় মমতায় যতটা পাড়া যায়, ততটাই কাটাতে ভালোবাসে মানুষ। ছুটে যায় দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ভরে ওঠে পার্ক, বিচ আর বিনোদনকেন্দ্রগুলো। সরগরম হয়ে ওঠে চারপাশ।

কিন্তু এই যে দীর্ঘ শীত, তখন কী করে মানুষগুলো! কেমন কাটে তাদের দিনগুলো? এদেশে ‘উইন্টার ডিপ্রেশন’ বলে একটা রোগও আছে। তখন পরিবেশটাই এমন হয়ে ওঠে যে কিছু ভালো লাগতে চায় না। ফলে কাজেকর্মে গতি কমে আসে বলে অনেকে মনে করেন। এমনকি কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা দেয় নানা ধরনের মানসিক সংকট।

শীতে দিনের আলো দেখা যায় খুবই কম। শুরু হয়েই যেন শেষ। সকালের শুরু হয় দেরিতে, আবার দিনের আলো মিলিয়ে যায় বিকাল হওয়ার আগেই। রাতটাকে অনেক দীর্ঘ মনে হয়। তার উপর বেশিরভাগ দিন হয় কেমন ঘোলাটে। চারপাশ জুড়ে থাকে কুয়াশা।

ধোঁয়াশা আকাশ দেখতে ভালো লাগে না। চারপাশে তাকালে বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে। কেননা গাছগুলো একেবারে পাতাহীন। শুধু দেহের কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শীতেও এদেশে বৃষ্টি হয়। কয়েকটি রাজ্য বাদে বাকিগুলোতে হয় তুষারপাত। আকাশ থেকে ঝরে পড়ে শ্বেতশুভ্র তুষার। অনেকসময় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। চলাচলও হয়ে ওঠে কঠিন। শীত থেকে বাঁচতে ভারি ভারি কাপড় জড়াতে হয় শরীরে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত যতটা মোটা কাপড়ে ঢেকে রাখা যায়। পায়ে লম্বা বুট। শরীরের অনেকটাই বাড়তি কাপড় নিয়ে চলাফেরা সহজ কাজ না।

এই যদি হয় শীতের অবস্থা, তাহলে শীতে এদেশের মানুষ কীভাবে তাদের দিন কাটায়, কীভাবে করে স্বাভাবিক কাজকর্ম, কিংবা কী হয় তাদের বিনোদন? এমন প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। এই দেশটা যেমন সুন্দর, তাদের ব্যবস্থাপনাগুলোও তেমনি সুন্দর।

প্রকৃতির বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ যুদ্ধ করে না। তারা প্রকৃতির নানা প্রতিকূলতাকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে নেয়। এই যেমন বলছিলাম, গাছগুলো পাতাহীন হয়ে যায়। আমার তো মনে হয়, তখন অন্যরকম এক ধরনের সৌন্দর্য তৈরি হয়। সারি সারি পাতাহীন বৃক্ষ দেখতে আমার খারাপ লাগে না। সৌন্দর্যের ধারণা এখানে ভিন্ন।

তুষারপাত তো এখানে রীতিমতো এক উৎসবের নাম। স্নো পড়ার দিন মানুষ এখানে উচ্ছ্বাস নিয়ে বের হয়ে আসে বাইরে। বিশেষ করে শিশুরা তুষার পড়ার দিনটাকে খুব আনন্দ নিয়ে উপভোগ করে। তারা ‘স্নো-ম্যান’সহ নানা ধরনের বরফের ভাস্কর্য বানায়।

ছবি তুলে মুহূর্তগুলোকে স্মরণীয় করে রাখে পরিবারগুলো। বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় আলাদা খাবার। চারপাশ ভরে ওঠে স্বর্গীয় সাদায়। বাড়িঘর, গাছপালা সবকিছু ঢেকে যায় সাদা বরফে। মনে হয় পুরো পৃথিবীটাই সাদা এক ভাস্কর্য।

তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় বরফ জমে তৈরি হয় স্কি খেলার মাঠ। বিশেষ করে ঢালু পাহাড়গুলোয়। পার্কগুলোতে তৈরি করা হয় কৃত্রিম আইস স্কেটিং রিং, আইস হকি খেলার মাঠ। তাছাড়া ইনডোর গেমস, মিউজিয়াম, থিয়েটার হলে থাকে বিনোদনের নানা ব্যবস্থা।

শীতকালীন বৃষ্টি অনেকের কাছে বিরক্তিকর হলেও এ সময় ঠাণ্ডাটা একটু কমে যায়। ফলে অনেকের ভালোও লাগে। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও গাড়ির ছাদে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ উপভোগ করেন না, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ফলে বৃষ্টিকে নিজের করে নিলে এই সময়টাও খারাপ লাগে না।

আর দিনের আলো কমে যায়! কি আর করা, তখন বরং রাতের অন্ধকারকে কতোটা বর্ণিল করে তোলা যায়, সেই প্রচেষ্টাও থাকে একের পর এক। বিশেষ করে শীত আসার সময় থেকেই শুরু হয় নানা আনন্দ-আয়োজন। চমৎকার সব উৎসব আসতে থাকে একে একে।

অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ‘হ্যালোউইন’ উৎসব। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় এই উৎসবের প্রস্তুতি। ভূত-প্রেতের নানা সরঞ্জাম দিয়ে বাড়ি সাজানো, ভৌতিক পরিবেশ তৈরির জন্যে বিশেষভাবে আলোকসজ্জা করা হয়।

তাছাড়া হ্যালোইনে নিজেদের সাজানোর জন্যে মানুষ কেনে বিশেষ পোষাক। শিশুদের জন্যে এই উৎসব বর্ণিল। ফলে শীতের আগমনী সময়টা বলতে গেলে পুরো অক্টোবর জুড়ে থাকে এই উৎসবের আনন্দ অনুভূতি।

হ্যালোউইনের রেশ কাটতে না কাটতে সামনে এসে দাঁড়ায় ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’। নভেম্বর মাসজুড়ে থাকে চমৎকার এই উৎসবের প্রস্তুতি ও আবহ। ভালো লাগা কমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই উৎসবে মিষ্টি কুমড়া ও টার্কির বিশেষ চাহিদা। ফলে সবকিছু তৈরি হয় এই দুটো ঘিরে।

‘থ্যাংকস গিভিং ডে’র পর পরই ‘ব্ল্যাক ফ্রাই ডে’ কিংবা ‘সাইবার মান ডে’তে কেনাকাটার জন্যে নির্ধারিত করে রাখে এদেশের মানুষ। কারণ এই দুটো দিনে বড় ধরনের মূল্য ছাড় পাওয়া যায়।

চলে আসে ডিসেম্বর মাস। আনুষ্ঠানিকভাবে শীতের শুরুটা হয় এই মাসে। এরই মধ্যে দেশের মানুষ শীতের জন্যে নিজেদেরকে তৈরি করে ফেলেছে। ফলে ডিসেম্বর জুড়ে চলা ক্রিসমাস তাদের মনে অন্যরকম আনন্দ এনে দেয়। বিভিন্ন বড় বড় ভবন সেজে ওঠে আলোর ঝরনাধারায়।

হোয়াইট হাউজ থেকে নিউ ইয়র্কের রকফেলার সেন্টারে সবার থাকে দৃষ্টি। বিপনিবিতান, খাবার দোকান, এয়াপোর্ট, এমনকি মানুষের বাড়িঘরে কেবল আলো, আলো আর আলো।

সবজায়গায় লাগানো হয় ক্রিসমাস ট্রি। সাজানো হয় জিঙ্গেল বেলসহ নানান রঙিন উপকরণ দিয়ে। করা হয় আলোকসজ্জা। এসময় বিশেষভাবে তৈরি কৃত্রিম ক্রিসমাস ট্রি’র চাহিদা ও বিক্রি দুটোই বেড়ে যায়। অনেকে আবার প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছ কিংবা গাছের অংশ কিনে নিয়ে আসেন।

সান্তা ক্লজের পোশাক ও টুপি বিক্রি বেড়ে যায়। শিশুরা নিজেদের চাহিদার কথা জানিয়ে সান্তা ক্লজের কাছে চিঠি লিখতে থাকে। সব ধর্মের মানুষই এইসব উৎসব উপভোগ করে। কেননা ধর্ম যার যার, আর উৎসব সবার।

ক্রিসমাস বা বড়দিনে মানুষ নানা ধরনের আনন্দ আয়োজনে মেতে ওঠে। এ উপলক্ষে দেওয়া হয় লম্বা ছুটি। ফলে মানুষ প্রিয়জনদের নিয়ে নিজেদের মতো করে ছুটি কাটায়। কেউ ঘুরতে বের হয়ে যায়। কারণ, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা কিংবা জর্জিয়ার মতো রাজ্যগুলোতে শীতেও অতোটা ঠাণ্ডা থাকে না।

আবার তুষারপাত দেখার জন্যে অনেকে ওইসব রাজ্য থেকে যায় নিউ ইয়র্ক, ভার্জিনিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি কিংবা আলাস্কায়। বড় দেশটির বিচিত্র আবহাওয়া। অনেকে অন্যদেশেও বেড়াতে যান।

এসময় অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড থাকে অনেকের পছন্দের তালিকায়। কেননা দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ হওয়ায় তখন এই দেশ দুটোতে রীতিমতো গ্রীষ্মকাল থাকে। অনেকে আবার দক্ষিণ আফ্রিকাসহ কয়েকটি দেশকে বেছে নেয়।

ক্রিসমাসের আনন্দ আয়োজনের সাথেই জড়িয়ে আছে নতুন বছরের আগমনী বার্তা। জানুয়ারির ১ তারিখ নতুন বছরে পা রাখে পৃথিবীর মানুষ। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। তবে থার্টি ফার্স্ট নাইট, মানে বছরের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর থেকেই উৎসব শুরু হয়ে যায়।

পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মানুষ নানাভাবে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। বিশেষ করে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের টাইমস স্কয়ারের দিকে থাকে পুরো পৃথিবীর মানুষের চোখ। পুরানো বছরের শেষ লগ্ন ও নতুন বছরের সূচনার সময়ে সুউচ্চ একটি ভবন থেকে যে বলটি গড়িয়ে পড়ে, এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘বল ড্রপ’। আর এই ‘বল ড্রপ’ দেখা ও নতুন বছরকে বরণ করে নিতে লাখো মানুষ জড়ো হন সেখানে।

জানুয়ারি মাস জুড়েই থাকে নতুন বছরের আনুষ্ঠানিকতা। যদিও তখন শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়। স্নো ফল হতে থাকে। কখনও তুষারঝড়ও হয়। তাতে নিত্যদিনের ভোগান্তি বাড়ে। এরপরও স্কুল-কলেজ চলে পুরোদমে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দম ফেলার সময় থাকে না। চলতে থাকে নিত্যদিনের কাজকর্ম। এর সাথে চলে নতুন বছরকে নানাভাবে বরণ করে নেয়াও। শীতের তীব্রতা উৎসবের রঙকে খুব বেশি স্পর্শ করতে পারে না।

আবার জানুয়ারি পেরুনোর আগেই শুরু হয়ে যায় ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র সুর। সবজায়গা সেজে ওঠে হৃদয়ের রঙে। লাল রঙের হার্ট আকার ধারণ করে বিভিন্ন স্থান। ভালোবাসার কতো রকম! প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা, বাবা-মা, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, দেশের প্রতি ভালোবাসা। ভালোবাসা মানবতার প্রতি।

মানবতাবাদী এ দেশের মানুষ তখন আরও বেশি করে তাদের অনুভূতির প্রকাশ ঘটান। এই দেশটির মতো এখানকার মানুষগুলোও অনেক সুন্দর। আর সেই সুন্দরের প্রকাশ তারা ঘটান নানানভাবে।

১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে’কে সামনে রেখে উৎসব পায় ভিন্ন মাত্রা। সেই প্রস্তুতি আর প্রাত্যহিক কাজ শীতকে ভীড়তে দেয় না খুব কাছে। এভাবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, তিন মাসে শেষ হয়ে যায় আনুষ্ঠানিক শীত পর্ব। ধীরে ধীরে প্রকৃতি জানিয়ে দিতে থাকে, বসন্ত এসে গেছে। যদিও তখনও শীতের তীব্রতা ভালোমতোই থাকে। কিন্তু গ্রীষ্ম আসবে, এই আশায় মানুষের মনে সেই তীব্রতা রেখাপাত করে না।

শুরুর দিকটায় ভারী পোশাকের কথা বলেছি। শীত তাড়াতে ওইসব পোশাক পরা হয়। অনেক সময় বাড়তি পোশাক কষ্ট দেয়- একথা সত্য। তবে ফ্যাশনের কথা যদি বলি, শীতের পোশাকগুলোর রয়েছে ভিন্ন আবেদন।

শীতকে সামনে রেখেই আসে চমৎকার সব পোশাক। বাহারি বুট-জুতো, যা মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। ছবি তোলার জন্যেও শীতের পোশাক বেশ ভালো। তাহলে আর কষ্ট কি! শীতও তো এখানে চমৎকার একটি উৎসবেরই নাম।

লেখক : 

ইয়োগা আর্টিস্ট ও লেখক

ছবি: আশরাফুন নাহার লিউজা

ইমেইল: Leuza.yoga@gmail.com

লেখকের অন্যান্য লেখা:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!