ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক: প্রকৃতি প্রতিবেশী

আমার বাসা থেকে রাস্তায় বের হলেই গাছ আর গাছ। রাস্তার দু'পাশে নানা রকম গাছের সারি। সেই রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে বেশ ভালো লাগে।

আশরাফুন নাহার লিউজা, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2016, 10:44 AM
Updated : 22 Oct 2016, 03:40 PM

কয়েকটা ব্লক হেঁটে পার হলেই খুব সুন্দর একটি জায়গা চোখে পড়ে। গাছ, পাহাড়ি পথ, পুকুর আর অসংখ্য পাখি- সবই আছে সেখানে। আছে বাচ্চাদের খেলার জন্যে চমৎকার ব্যবস্থা।

বার বার যেতে যেতে এই জায়গাটি হয়ে উঠেছে আমার অতি আপন ও প্রিয় স্থান। আমি বলি, ‘প্রকৃতি প্রতিবেশী’। ভালো প্রতিবেশীর মতোই যে জায়গাটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। বলছিলাম ক্যাপ্টেন টিলি পার্কের কথা।

জ্যামাইকা হিল সাইডের এই পার্কটি বহু মানুষের প্রিয় গন্তব্য। আয়তনে খুব বেশি বড় নয়। মাত্র নয় একর। সাজানো, পরিপাটি। অসংখ্য গাছ-গাছালিতে ভরা।

গ্রীষ্মে সবুজের চাদরে ঢাকা থাকে পার্কটি। আবার শীতে একেবারে ভিন্ন রূপ। শ্বেতশুভ্র বরফে যখন ঢেকে যায়, তখন দেখতে খুব অচেনা লাগে। 

পার্কের অন্যতম অনুসঙ্গ স্বচ্ছ পানির একটি পুকুর। নাম ‘গুজ পন্ড’। এই পুকুরকে ঘিরে হাঁসের মিলনমেলা। অনেক পাখির পছন্দের জায়গা এটি। পুকুরের মাঝখানে এক টুকরো জংলি ঘাসে ঘেরা দ্বীপের মতো জায়গা। পাখিদের অভয়ারণ্য। 

এবার আসি পার্কটির নামকরণ সম্পর্কে। ক্যাপ্টেন জর্জ এইচ টিলি ‘আর্মি সিগনাল’ গ্রুপের হয়ে ১৮৯৮ সালের স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেই যুদ্ধে তিনি মারা যান। জ্যামাইকা এলাকায় বসবাসকারী ধনাঢ্য এক পরিবারের সন্তান ছিলেন ক্যাপ্টেন টিলি। পার্কটির নামকরণ হয়েছে তারই নামে। 

পার্কের জায়গাটিও একসময় টিলি পরিবারের ছিল। পরে মালিকানা দেয়া হয় ‘হাই ল্যান্ড পার্ক সোসাইটি’র কাছে। ১৯০৮ সালে পার্ক কর্তৃপক্ষ মাত্র এক ডলারের বিনিময়ে এটিকে নিউ ইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। শর্ত ছিল, জায়গাটিকে কেবল পার্ক হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে। এক সময় হাই ল্যান্ড পার্ক বলা হলেও, ১৯৩৫ সালে এটির নাম বদলে করা হয় ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক।

পার্কে স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের বেশ কিছু স্মারক রয়েছে। বড় একটি স্ট্যান্ডে গৌরবে উড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। পরতে পরতে সৌন্দর্যের পসরা। সবচেয়ে বড় কথা, স্থানীয় মানুষদের প্রিয় মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই পার্ক। এমনকি মেলা ও পিকনিকের মতো সামাজিক নানা আয়োজনও হয়ে থাকে এখানে।

ছোট এই পার্কটি বৈচিত্রে ভরপুর। রক্ষণাবেক্ষণও এক কথায় অসাধারণ। গুজ পন্ডকে ঘিরে রয়েছে একটি ওয়াকিং ট্রেইল। ঘূর্ণায়মান মসৃণ এই পথটি অনেক মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়। কেননা প্রতিদিন সকাল-বিকালে এই পথ জুড়েই মানুষ হেঁটে বেড়ায়। পুকুরটির চারপাশে কাঠের বেঞ্চ ক্লান্ত কিংবা উদাস পথিককে আশ্রয় দেয়। বসে থাকতে ভালো লাগে।

পার্কটির পাশে রয়েছে এক খণ্ড পাহাড়ি পথ। সেই পথের দুই ধারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজি যেন সবাইকে অভিবাদন জানায়। রাস্তাটির কোথাও কোথাও গাছের জন্য সূর্যের আলো পৌঁছায় না। গ্রীষ্মে ঘনসবুজের এই অরণ্যে কেবল হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছা করে। হাঁটতে হাঁটতেই কখনো মনে হয়, প্রজাপতি হয়ে পাখনা মেলে উড়ে বেড়াই।

ক্যাপ্টেন টিলি পার্কের সাথে আমার একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে যেন। নিউ ইয়র্কের দিনগুলোতে কখনো একা, কখনো পরিবারের সাথে অনেক সময় কেটেছে এই পার্কে। এখনো কাটছে। এই পার্ক আমার আনন্দ-বেদনার সঙ্গী। আমার প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। কারণ এখানেই নিয়মিত ইয়োগার চর্চা, হেঁটে বেড়ানো কিংবা আমার মেয়েটাকে নিয়ে হাঁসের সাথে খেলা করা আমার প্রিয় কাজ। নিজেকে তৈরি করার একটি অনন্য স্থান ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক।

এই ফল সিজনে এখানে বসে প্রায়ই শুনি ঝরা পাতার রিনিঝিনি কাব্য। কিংবা কখনো চেয়ে দেখি মাথার উপরে শুভ্র মেঘেদের ওড়াউড়ি। লেখালেখির জন্যে নিরব ভাবনা, কিংবা ইয়োগা চর্চার জন্যে কখনো খানিকটা প্রকৃতির সান্নিধ্য- আমাকে নিয়ত দিয়ে যাচ্ছে ‘ক্যাপ্টেন টিলি পার্ক’। আমার প্রকৃতি প্রতিবেশী তুমি ভালো থাকো।

লেখক: ইয়োগা আর্টিস্ট, লেখক এবং উপস্থাপক।

এই লেখকের আরও পড়ুন: