আস্থার নাম স্ট্যাচু অব লিবার্টি

জুলাই মাস শেষের দিকে। পুরো সামার চলছে। আকাশে ঝকঝকে রোদ। তার উপর ছুটি। এমন দিনে কি ঘরে বসে থাকা যায়! আমরা চলেছি স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে।

আশরাফুন নাহার লিউজা, নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2017, 12:22 PM
Updated : 9 Dec 2017, 03:17 AM

‘আর’ ট্রেনে করে হোয়াইট হল স্ট্রিটে নেমে কিছুটা হাঁটার পথ ব্যাটারি পার্ক। সেখান থেকেই ফেরি ছেড়ে যায় লিবার্টি আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। টিকেট কেটে ফেরিতে ওঠার জন্যে লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়িয়েছি। অসংখ্য মানুষ এসেছে, আমেরিকার গৌরব স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখার জন্যে।

ব্যাটারি পার্ক থেকেই স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে দেখা যায়। তবে কাছ থেকে দেখার আনন্দই অন্যরকম। আমরা লম্বা লাইন ঠেলে যে ফেরিতে উঠলাম, তার নাম ‘মিস নিউ ইয়র্ক’।

নামটা দেখে মজা পেলাম। সোজা উপরের ডেকে চলে গেলাম। নানান দেশের নানান মানুষ চারপাশে। সবার যাত্রা একদিকে। নীল জলরাশিতে যেন আকাশটা মিশে গেছে। হুইসেল দিয়ে চলতে শুরু করলো ফেরি। তিরতির করে এগিয়ে চলেছে। মৃদমন্দ বাতাস রৌদ্রের খরতাপকে গায়ে লাগতে দিচ্ছে না। দেখতে দেখতে খুব কাছে চলে এলো। এই তো চোখের সামনে স্বপ্নের স্ট্যাচু অব লিবার্টি। কেমন যেন শিহরিত বোধ করলাম।

ফেরি থেকে নামতেই সুন্দর একটি দ্বীপ। ছোটখাটো, ছিমছাম। পুরো দ্বীপটা ঘুরে আসতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। সবদিক থেকে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ দেখা যায়; মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালাম। ছুঁয়ে দেখবো বলে।

ঢিলেঢালা সবুজাভ রঙের উড়ন্ত গাউন পড়ে থাকা এক নারীর অবয়ব ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। মাথায় সূচালো কাঁটাওয়ালা মুকুট; যা কিনা সাতটি মহাদেশ ও সাত সমুদ্রের প্রতীক।

ভাস্কর্যটির বাম হাতে রয়েছে একটি বই, যাতে রোমান সংখ্যায় খোদাই করে লেখা রয়েছে ‍‌আমেরিকার স্বাধীনতার দিনক্ষণ ৪ জুলাই, ১৭৭৬ সাল।

ডান হাতে উঁচিয়ে ধরা একটি মশাল। পায়ে পড়ে থাকা ছেঁড়া শেকল, মুক্তির কথা বলছে। এই ভাস্কর্যটি সাম্য, স্বাধীনতা এবং মুক্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

ডান হাতে ধরে রাখা মশাল পর্যন্ত মূল ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১৫১ ফুট ১ ইঞ্চি। তবে মাটি থেকে যদি মাপা হয় বেদিসহ ভাস্কর্যটির পুরো উচ্চতা ৩০৫ ফুট ১ ইঞ্চি। আমেরিকার ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসেস এই ভাস্কর্যটির রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ভাস্কর্যটির পরিচিতি ছিল ‘লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে। পরে এটির নাম বদলে ফেলা হয়। রাখা হয়, ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’।

নিউ ইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটনের আপার নিউ ইয়র্ক বে’র দুটি ক্ষুদ্র দ্বীপ লিবার্টি আইল্যান্ড ও এলিস আইল্যান্ড। এই দুটি দ্বীপের সঙ্গে আমেরিকার অভিবাসীদের আগমনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। স্ট্যাচু অব লিবার্টির অবস্থান লিবার্টি আইল্যান্ডে।

আর খুব কাছাকাছি থাকা এলিস আইল্যান্ডকে বলা হয় লাখ লাখ অভিবাসীর প্রবেশ দরজা।  ১৮৯২ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নৌপথে আসা প্রায় ১৬ লাখ অভিবাসী এলিস আইল্যান্ড দিয়ে আমেরিকায় ঢুকেছে। এদেশে আসা অভিবাসীরা তখন স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে, নতুন আশায় বুক বেঁধেছে।

বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে বন্ধু দেশ ফ্রান্স, ভাস্কর্যটি উপহার দেয়। ফ্রান্সের রাজা তৃতীয় নেপোলিয়ানের সময় এডওয়ার্ড রিনি লাবলাহ নামে এক ফরাসি পণ্ডিত প্রথমে ভাবনাটি মাথায় আনেন।

তার ভাবনায় ছিল একটি সিভিল ওয়্যারে জয়ী হয়ে, আমেরিকা একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। তাই দেশটির সাথে বন্ধুত্বের চিন্তা করা হয়।  তখন তিনি একজন বিখ্যাত ভাস্কর ফ্রেডরিক আগস্টে বারথোল্ডির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।

১৮৭১ সালে ভাস্কর্যটি বানানোর প্রস্তাব নিয়ে আমেরিকায় আসেন বারথোল্ডি। ভাস্কর্যটি স্থাপনের জন্যে সেইসময় নিউ ইয়র্কের লিবার্টি আইল্যান্ডকে বাছাই করা হয়। ভাস্কর্য নির্মাণ উপলক্ষ্যে ১৮৭৫ সালে ‘ফ্রান্স-আমেরিকান ইউনিয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বলা হয় আমেরিকা ভিত ও বেদি তৈরির খরচ বহন করবে। আর ফ্রান্স বহন করবে মূল মূর্তি তৈরির খরচ।

ভাস্কর্যটির বেদি তৈরির অর্থ জোগাড়ে ভূমিকা রেখেছেন বিখ্যাত পত্রিকা প্রকাশক জোসেফ পুলিৎজার। আমেরিকায় শিল্প, সাহিত্য, নাটক এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটির নাম ‘পুলিৎজার’; যার প্রবর্তকও তিনি।

আইফেল টাওয়ারের স্থপতি ইঞ্চিনিয়ার আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেল তখন স্ট্যাচু অব লিবার্টির নকশা করেন। ফ্রেডরিক আগাস্টে বারথোল্ডির সাথে মিলে তিনি এই অসাধারণ ভাস্কর্যটি নির্মাণে কাজ করেন। নির্মাণ শেষ করতে প্রায় ২ বছর ফরাসি ও আমেরিকান ভাস্কররা কাজ করেছেন। পুরু পেটানো তামার পাত এবং লোহার ফ্রেমের উপর দাঁড় করানো ভাস্কর্যটিকে, ৩০০ খন্ডে তৈরি করা হয়। ১৮৮৪ সালে জুন মাসে কাজ শেষ হলে ফ্রান্সের প্যারিসে তা সংরক্ষণ করে রাখা হয়। পরে ১৮৮৫ সালে বিভিন্ন অংশ খুলে ২১৪টি বাক্সে ভরে জাহাজে করে আমেরিকায় পাঠানো হয়। প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ১৮৮৬ সালের ২৮শে অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন ভাস্কর্যটির।

ধীরে ধীরে ভাস্কর্যটির পরিচিত দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯২৪ সালে স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে আমেরিকার ন্যাশনাল মনুমেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো ভাস্কর্যটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮৬ সালে স্ট্যাচু অব লিবার্টির শত বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ব্যাপক সংস্কার করা হয়। তখন এর হাতের মশালটি গ্লাস ও মেটালের পরিবর্তে সোনার পাত দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়।

আমেরিকার গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রধানতম নিদর্শন এই বিশালাকৃতির ভাস্কর্যটি। প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে আসেন। যারা আমেরিকা দেখতে আসেন, তাদের একটা চেষ্টা থাকে নিউইয়র্কে বেড়ানোর। আর কেউ নিউইয়র্কে এসে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ না দেখে ফিরে গেছেন, সেই সংখ্যা অনেক কমই হবে।

স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে ছুঁয়ে দেখা হয়েছে। এবার ঘুরে ঘুরে দেখছি আমরা। ১৯২টি সিঁড়ি পেরিয়ে অথবা এলিভেটর দিয়ে বেদির ওপরে অবস্থিত অবজারভেশন টাওয়ারে যাওয়া যায়। বেদির ভেতরে রয়েছে একটি মিউজিয়াম। যেখানে আছে এই ভাস্কর্যের অনেক ঐতিহাসিক দলিল ও নিদর্শন। যাওয়া যায় ভাস্কর্যের মুকুটের কাছে। যেখান থেকে নিউ ইয়র্ক হারবার ও নিউইয়র্ক সিটির অনন্য দৃশ্য দেখা যায়। ভাস্কর্যটির ভেতরে পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে রোমাঞ্চ।

এককথায় পুরো দ্বীপটাই অনেক সুন্দর। খাবার দাবারের রকমারি আয়োজন রয়েছে। আছে স্যুভিনির শপ; প্রচুর বৃক্ষরাজি। দ্বীপের চারপাশে কংক্রিটের বাঁধাই। যত দূর চোখ যায় অথৈ জল। সাগরের বুকে নৌযানগুলোকে দেখতে চমৎকার লাগে। আর তাকালে দূরে চোখে পড়ে ম্যানহাটনের বড় বড় দালানগুলো। অদ্ভূত ভালোলাগার পরিবেশ। ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল আকাশটা হঠাৎ মেঘে ঢেকে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে এলো বৃষ্টি। দ্বীপে রহস্যময় একটা পরিবেশ তৈরি হলো। ভালো লাগা বাড়িয়ে দিল অনেকগুণ।

লেখক : ইয়োগা আর্টিস্ট ও লেখক

ইমেইল: Leuza.yoga@gmail.com

লেখকের অন্যান্য লেখা:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!