একেক উৎসব একেক রকম হলেও সেই উৎসবের সাথে মিলিয়ে বাজারে বের হয় বাহারি সব পণ্য, পোশাক-আশাক, আরও কত কি! এই যেমন এবারের হ্যালোউইনে চারিদিকে কেবল কমলা রঙের ছোঁয়া। সেই সাথে কালোর মিশেল।
কমলা রঙ নেওয়া হয়েছে পামকিন বা মিষ্টি কুমড়া থেকে। আর কালো তো ভয়ের রঙ। ভূত-প্রেতের সাথে কালোর একটা সম্পর্ক রয়েছে। কয়েকদিন ধরে এই রঙটির বেশ আধিক্য চোখে পড়ল। বিশেষ করে শপিংমল, রেস্টুরেন্ট কিংবা বাজারে।
ঘরবাড়ির উঠোন কিংবা মূল প্রবেশ দরজায় মানুষের মুখের আদলে গড়ে তোলা কুমড়ার খোল আর ভূত-প্রেতের প্রতীকী আয়োজন। উপলক্ষ ‘হ্যালোউইন’। আর এই ‘হ্যালোউইন’ কিন্তু ভয় তাড়ানোর উৎসব।
এই উৎসবটি শিশুরা খুব উপভোগ করে। বাদ যায় না বড়রাও। এই দেশে বোধ হয় এটা খুব জোড়ালোভাবে বলা যায়, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষ থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। আর সবাই এসব উৎসব উপভোগ করে প্রাণভরে।
স্কটিশ ভাষার ‘অল হ্যালোজ ইভ’ থেকে এসেছে ‘হ্যালোউইন’ শব্দটি। যার অর্থ ‘শোধিত সন্ধ্যা’ বা 'পবিত্র সন্ধ্যা'। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে ‘অল হ্যালোজ ইভ’ শব্দটি ‘হ্যালোউইন’ হয়ে গেছে।
প্রায় দুই হাজার বছর আগে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বসবাস করতো কেল্টিক জাতি। তারা অক্টোবরের শেষের একটি দিনের রাতকে সবচেয়ে খারাপ হিসেবে মনে করতো। যে রাতে সব প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মা তাদের মাঝে ফিরে আসে। এদের সঙ্গে যদি মানুষের দেখা হয়, তবে সেই মানুষের ক্ষতি হতে পারে।
মনে করা হয়, এই দিনটিতে উড়ন্ত ঝাড়ুতে করে হ্যালোউইন ডাইনি আকাশজুড়ে উড়ে বেড়ায়। কখনো সবুজ খরখরে দেহের ডাইনি বুড়ি কড়া নাড়ে বাড়ির দরজায়। ফলে তারা ঐ রাতে বিভিন্ন রকম ভূতের মুখোশ ও কাপড় পরে থাকে।
রাতে আগুনের পাশে মুখোশ পরে বৃত্তাকার হয়ে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র বলা, নিজের পরিবার ছোট হলে অন্যের বাড়িতে থাকাসহ সামাজিকভাবে একসাথে থাকা- এসব হ্যালোউইনের বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেল্টিক জাতির সেই 'সাহ-উইন' উৎসবই এখনকার দিনের 'হ্যালোউইন'।
উৎসবটির সাথে দুটো ব্যাপার জড়িত। একটি হল 'ট্রিক অর ট্রিট', আর আরেকটি 'জ্যাকের বাতি'। এদিনে শিশুরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরজা নক করে বলে 'ট্রিক অর ট্রিট'। এর মানে হচ্ছে, তোমাকে নিয়ে কোনো 'ট্রিক' করা হবে, অথবা 'ট্রিট' দাও। তখন সেই বাড়ি থেকে তাদের ঝুলিতে কিছু ক্যান্ডি দেয়া হয়।
কেবল বাড়ি বাড়ি গিয়েই নয়, নিউ ইয়র্কের শিশুরা বিভিন্ন দোকান ও রেস্টুরেন্টে গিয়েও ক্যান্ডি পাওয়ার আশায় 'ট্রিক অর ট্রিট' বলে। এসব দোকান ও রেস্টুরেন্টে ক্যান্ডি রাখা হয়। দলে দলে শিশুরা এক দোকান থেকে পাশের রেস্টুরেন্ট, সেখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। বাহারি সব পাত্র বা থলে থাকে তাদের সাথে। সেগুলো ক্যান্ডিতে ভরে যায়। কে কার চেয়ে বেশি ক্যান্ডি সংগ্রহ করতে পারে, সে নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। ফলে একসময় ক্যান্ডি শপের ক্যান্ডিতে টান পড়ে যায়। শিশুদের সাথে কখনো থাকে বড়রা। অদ্ভূত সুন্দর একটি উৎসব।
যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের হ্যালোইন উৎসব দিনভরই চলে। এই দিনে শনি বা রোববার না হলে, সরকারিভাবে ছুটি থাকে না। ফলে সকালে উঠে তাদেরকে স্কুলে যেতে হয়। তবে মজাটা হচ্ছে, স্কুলের পোশাকে নয়, যাওয়া যায় মজার সব কস্টিউম পরে। কেউ ভূত-প্রেত, কেউ সিনেমায় দেখা হিরো-হিরোইন, কেউবা গল্প কাহিনীর কোনো চরিত্র সেজে স্কুলে যায়। সেখানে প্যারেড হয়। বন্ধুরা মিলে অনেক মজা করে। আর ফিরে এসে আসল মজা হয়, রাতে। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামার পর। আলো যখন ফুরিয়ে আসে, তখনই না ভূত সেজে মজা।
এখানেই শেষ নয়। হ্যালোউইনকে ঘিরে নানান আয়োজন চলে। এই যেমন, এবার নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে হয়ে গেল প্যারেড। জমকালো সেই প্যারেড ছিল দেখার মতো। চমৎকার। তবে যাদের হার্ট দুর্বল, তাদের জন্যে একটু সমস্যাই বটে। কেননা একসাথে ভয়ংকর সব ভূতের কবলে পড়লে কারই বা ভয় না লাগে। বিশেষ করে নানান ধরনের মুখোশ পরে মানুষ বেড়িয়েছিল পথে।
এবার যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের কারণে প্রধান দুই প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এবং ডনাল্ড ট্রাম্পের বেশ সরব উপস্থিতি ছিল হ্যালোউইন উৎসবে। তারা নিজেরা অংশ নিয়েছেন এমনটা বলছি না। তাদের মুখোশ বেশ বিকিয়েছে। তাদেরকে নিয়ে মজা করেছেন অনেকেই। আর এদেশে এসব করাই যায়। ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কথা!
প্যারেড ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় রাতভর চলে 'হ্যালোউইন পার্টি'। অনেকে ভূতের সিনেমা দেখেন। কেউবা দলে দলে চলে যান দূরে, বনে বাদাড়ে। ভয়ের মধ্য থেকে, ভয় তাড়ানোর উৎসব হচ্ছে 'হ্যালোউইন'।
লেখক: ইয়োগা আর্টিস্ট, লেখক এবং উপস্থাপক।
এই লেখকের আরও পড়ুন: