শত বছরের ঐতিহ্য টাইমস স্কয়ারের বর্ষবরণ

বর্ষবরণের কথা সামনে এলেই পহেলা বৈশাখের কথা মনে পড়ে যায়। বাঙালির মনন ও চেতনার রঙে রঙিন হয়ে থাকা এই উৎসব বরাবরই আমার প্রিয়।

আশরাফুন নাহার লিউজা, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2017, 11:44 AM
Updated : 8 Jan 2017, 11:44 AM

একই সাথে আমি ভালোবাসি খ্রিস্টিয় নতুন বছরকে বরণ করে নিতে। কেননা এর মধ্য দিয়ে পরিবর্তন আসে পুরো পৃথিবীতে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে। গোটা পৃথিবীজুড়ে যেভাবে নতুন বছরকে আদরে বরণ করে নেওয়া হয়, তা দেখতে আমার সবসময়ই বেশ ভালো লাগে।

গত দুইবছর ধরে নিউ ইয়র্কে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা দেখছি। এককথায় জমকালো। নতুন বছরের আগমনে পুরো নিউ ইয়র্ক সেজে ওঠে নতুন সাজে। তবে এখানকার মূল আনুষ্ঠানিকতা হয় টাইমস্‌ স্কয়ারে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, নতুন বছর বরণে সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি থাকে ম্যানহাটনের এই জায়গাটির দিকে।

টাইমস স্কয়ারের এবারের আয়োজনটিও ছিল বেশ জমজমাট। তবে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের হুমকির কারণে নেওয়া হয়েছিল বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তারপরও সাধারণ মানুষের আনন্দে কোন কমতি ছিল না। দেশটির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, সারা পৃথিবী থেকেই এসেছিলেন অসংখ্য পর্যটক।

উৎসব শুরু হয়ে যায় কয়েকদিন আগে থেকেই। তবে মূল আনুষ্ঠানিকতা ছিল ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে। আর এবারের আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুন। সাথে ছিলেন নিউ ইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও।

প্রতি বছরই এমন অতিথি থাকেন। যিনি ওয়াটারফোর্ড ক্রিস্টাল বল ফেলার সুইচ টিপে পুরানো বছরকে বিদায় জানান। বিভিন্ন সময়ের অতিথিদের তালিকা অনেক লম্বা।

আগের বছরই এসেছিলেন জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী টেইলর সুইফট। ২০০১ সালকে বরণ করে নেওয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন জগৎসেরা মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। ২০০৯ সালকে বরণ করে নেওয়ার অনুষ্ঠানে ছিলেন বিল ও হিলারি ক্লিনটন দম্পতি। বলা যায় আরও অনেকের নাম।

টাইমস স্কয়ারের এই আয়োজন শত বছরের ঐতিহ্য। তার সাথে আধুনিকতা মিশে অনন্য একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। ১১০ বছর ধরে চলে আসা এই অনুষ্ঠানের শুরুটা হয়েছিল ১৯০৭ সালে। সে বছর ৩১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো এই ইভেন্টটি অনুষ্ঠিত হয়।

এই ইভেন্টটি প্রথম শুরু করা হয়েছিল ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর মালিক এডলফ ওচসের উদ্যোগে। এরপর থেকে প্রতি বছরই জমকালো আয়োজনে এখানে বর্ষবরণ হয়ে থাকে। তবে ১৯৪২ এবং ১৯৪৩ সালে যুদ্ধকালীন ‘ব্ল্যাক আউট’-এর কারণে এই অনুষ্ঠান হয়নি। বর্তমানে এই অনুষ্ঠানটি ‘টাইমস স্কয়ার অ্যালায়েন্স’ এবং ‘কাউন্ট ডাউন এন্টারটেইনমেন্ট’ যৌথভাবে আয়োজন করে।

আয়োজনের প্রধান আকর্ষণ ‘টাইম বল’। যেটিকে বলা হয়, ‘ওয়াটারফোর্ড ক্রিস্টাল বল’। ‘ওয়ান টাইমস স্কয়ার’-এর ছাদে এই বল রাখা থাকে। পুরানোকে বিদায় এবং নতুনকে স্বাগত জানানোর অংশ হিসেবে বলটিকে ফেলা হয়, যেটিকে বলা হয় ‘বল ড্রপ’। ৬০ সেকেণ্ড সময়ের মধ্যে, ১৪১ ফুট উঁচু থেকে বলটিকে ফেলা হয়। যা শুরু হয় ১১ টা ৫৯ মিনিটে। এরপরই নতুন বছরের শুরু।

প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখ মানুষ এই অনুষ্ঠানটি দেখতে এখানে জড়ো হন। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীদের পরিবেশনা এই অনুষ্ঠানে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। সেই সাথে চোখ ধাঁধানো আতশবাজি।

অনুষ্ঠানটি মধ্য রাত থেকে শুরু হলেও সকাল থেকে অনুষ্ঠানের জায়গাটিতে আসতে শুরু করেন লাখো মানুষ। কারণ, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এত মানুষ জড়ো হয়ে যায় যে মূল অনুষ্ঠানস্থলের কাছে ঘেষাই তখন সম্ভব হয় না। ফলে যারা কাছ থেকে অনুষ্ঠান দেখতে চান, তারা মোটামুটি ব্রেকফাস্ট করেই টাইমস স্কয়ারের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। সারাটা দিন সেখানে অপেক্ষা করেন। নিজেরা নিজেদের মতো করে আনন্দে মেতে থাকেন। নানান রঙের পোশাকে বর্ণিল হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। প্রচণ্ড শীত যেন কোন ব্যাপারই নয়।

সন্ধ্যা গড়ানোর পর শুরু হয় অনুষ্ঠান। চলতে থাকে, একের পর এক চোখ ধাঁধানো পরিবেশনা। পৃথিবীর সেরা সংবাদমাধ্যমগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে। পৃথিবীর কোটি মানুষ চেয়ে থাকে সেদিকে।

‘সবার জন্যে সাফল্যের বছর হবে ২০১৭’ এমন প্রত্যাশা নিয়ে এ বছর নিউ ইয়র্কের মানুষ নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে। টাইমস স্কয়ারে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড়ে ছিলেন পৃথিবীর প্রায় সব ধর্ম-বর্ণ ও দেশের মানুষ।

নেচে গেয়ে জমিয়ে রাখেন জনপ্রিয় শিল্পীরা। মারাইয়া কেরির গানের সময় যান্ত্রিক ত্রুটি অবশ্য পরে খবরের শিরোনাম হয়েছে। এরপরও সব মিলিয়ে আয়োজন ছিল দেখার মতো।

সময় যখন ঘনিয়ে আসে, ‘বিগ অ্যাপল’ খ্যাত ‘ক্রিস্টাল বল’-এর বোতাম চাপেন জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুন। এ সময় ১২ ফুট ব্যাসের ১১ হাজার ৮৭৫ পাউন্ড ওজনের বিশাল আলো ঝলমলে স্ফটিক গোলক নেমে আসে নিচের দিকে। বলটিতে জ্বলে ওঠে নানা রঙের ৩২ হাজার ২৫৬টি এলইডি বাতি। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।

ক্ষণ গণনার পরে পৃথিবী পা রাখে আরও একটি নতুন বছরে। আতশবাজির আলোয় ভেসে যায় চারিদিক। আকাশ থেকে ঝরতে থাকে কোটি রঙিন কাগজ। চারিদিক ভেসে গেল সেই রঙিন কাগজের বৃষ্টিতে। সবার মনে তখন নতুন আশা। চেয়ে থাকা সম্ভাবনার দিকে।

লেখক: ইয়োগা আর্টিস্ট,লেখক ও উপস্থাপক।

ইমেইল: Leuza.yoga@gmail.com

আশরাফুন নাহার লিউজার আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!