ধন্যবাদ দেওয়ার দিন

আমেরিকানরা উৎসবপ্রিয় জাতি। ১২ মাস জুড়ে তাদের নানা উৎসব। কেবল ধন্যবাদ দেওয়ার জন্যেই একটা দিন ! আবার সেই দিনকে ঘিরে কত আনন্দ-আয়োজন !

আশরাফুন নাহার লিউজা, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Nov 2016, 11:40 AM
Updated : 25 Nov 2016, 12:52 PM

প্রকৃতির বৈরি আচরণ, কিংবা শীতের ঘনঘটা- এসব কোন বাধাই হতে পারে না। বলছি ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’র কথা।

একটা সময় ছিল, দিনটিকে কেবল ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হিসেবে দেখা হতো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া হতো তার করুণার জন্যে। কিন্তু এখন বিষয়টি সেখানেই সীমাবদ্ধ নেই। ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে ব্যক্তি পর্যায়ে।

মানুষ একে অপরকে নানা কারণে ধন্যবাদ দিচ্ছে। স্বীকৃতি দিচ্ছে কাজের। বন্ধু, সহকর্মী, পরিবার-পরিজন সকলের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে দিনটি। ধন্যবাদ দেওয়ার দিনটি এখন রূপ নিয়েছে সার্বজনীন একটি উৎসবে।

এই উৎসবের ধর্মীয় কিংবা জাতিগত সীমানা নেই এখন। কারণ ‘ধন্যবাদ’ দিতে কোন কিছুরই প্রয়োজন হয় না। কেবল চাই আন্তরিক সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছার প্রতিফলনই ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’।

প্রতি বছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার আমেরিকায় ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ পালিত হয়। কানাডাতেও এই উৎসব পালন করা হয়। তবে সময়টা একেবারেই ভিন্ন। আর সেটা অক্টোবরের দ্বিতীয় সোমবার।

‘থ্যাংকস গিভিং ডে’কে এক অর্থে বলা হয় ‘টার্কি ডে’। কারণ এই উৎসবে বনমোরগ জাতীয় টার্কি পাখির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। খাবারের মেনুতে টার্কি ছাড়া এদিন চলেই না। টার্কি মোরগের রোস্টের সাথে থাকে ক্র্যানবেরি সস,মিষ্টি আলুর ক্যান্ডি,স্টাফিং,ম্যাশড পটেটো আর ঐতিহ্যবাহী পামকিন পাই। 

‘থ্যাংকস গিভিং ডে’র ইতিহাসটাও বেশ গুরুত্ববহ। ১৬২০ সালের কথা। ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামে একটি জাহাজে চড়ে নানা ধর্মের ১০২ জন মানুষ। স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার জন্যে ইংল্যান্ড ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে বের হন তারা।

কয়েকমাসের ভ্রমণ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বে’তে এসে থামেন তারা। তখন যাত্রীদের অনেকেই অর্ধাহারে ও শীতের প্রকোপে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

জাহাজ নোঙর করে সেখানে তারা ‘প্লিমথ’ নামে একটি গ্রাম গড়ে তোলে। তখন ‘স্কোয়ান্তো’ নামে এক উপজাতি আমেরিকান-ইন্ডিয়ানের সাথে পরিচয় হয় তাদের। সেই স্কোয়ান্তোই হয়ে ওঠেন তাদের বন্ধু, আত্মার আত্মীয়।

তিনি তাদেরকে শিখিয়ে দেন কীভাবে ভুট্টা চাষ করতে হয়। সেই সাথে মাছ ধরা কিংবা ম্যাপল গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার উপায়ও বাতলে দেন তিনি।

১৬২১ সালের নভেম্বর মাসের কথা। সেবার প্লিমথবাসী তাদের উৎপাদিত ভুট্টা নিজেদের ঘরে তুলতে পেরেছিল। ভুট্টার ফলন এত ভালো হয়েছিল যে,সেখানকার গভর্নর উইলিয়াম সে উপলক্ষে একটি ভোজের আয়োজন করেন। এতে আমন্ত্রণ পায় সব আদিবাসী এবং সেই প্লিমথ গ্রামের মানুষেরা।

ওই অনুষ্ঠানে সবাই প্রথমে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান তাদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এরপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এমন সুন্দর শস্য দেওয়ার জন্য। উপস্থিত সবাই একে অপরকে ধন্যবাদ জানান সারা বছরের সহযোগিতার জন্য। সেই অনুষ্ঠানটিই আমেরিকার প্রথম ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

নিউ ইয়র্কে প্রথমবারের মতো ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ অফিসিয়ালি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৮১৭ সালে। এরও দশ বছর পর, ১৮২৭ সালে বিখ্যাত নার্সারি রাইম ‘মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব’-এর রচয়িতা সারাহ যোসেফা হ্যালে উদ্যোগ নেন ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’-কে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার।

দীর্ঘ ৩৬ বছর সারাহ যোসেফা হ্যালে একটানা এর পক্ষে প্রচারণা চালান। ১৮৬৩ সালে, তখনকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন শেষ পর্যন্ত সারাহ যোসেফার দাবি মেনে নিয়ে নভেম্বর মাসের শেষ বৃহস্পতিবারকে ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।

কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ১৯৩৯ সালে তখনকার অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্যে এই ছুটি এক সপ্তাহ এগিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এরপর থেকে নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ পালিত হয়ে আসছে।

দিনটি আমেরিকানদের জন্যে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টও মহা আয়োজনে তা উদযাপন করেন।

এখন ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’র প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বর্ণাঢ্য এক প্যারেড,যা ‘মেসিস প্যারেড’ নামে পরিচিত। বিশ্ব বিখ্যাত ডিপার্টমেন্টাল চেইন স্টোর ‘মেসিস’ এই প্যারেডের আয়োজক। নানান ধরনের পোশাক পরে রঙিন এই প্যারেডে যোগ দেয় হাজারো মানুষ। তা দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট ছাড়াও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসে অসংখ্য পর্যটক।

সাধারণত সকাল ৯টার দিকে এই প্যারেড শুরু হয়। আর দেখার জন্যে ভালো একটু জায়গা পেতে মধ্য রাত থেকেই ভিড় করতে শুরু করে দর্শনার্থীরা। প্যারেড শুরু হয় ম্যানহাটনের ৭৭ স্ট্রিটের সিক্স অ্যাভিনিউর উপর থেকে।

রাস্তায় মার্চ করে এই প্যারেড গিয়ে শেষ হয় হেরাল্ড স্কয়ারে ৩৪নং স্ট্রিটের ‘মেসিস’ এর সামনে গিয়ে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ নানান মহড়া চলে। মানুষ গভীর আনন্দ নিয়ে উপভোগ করে এই আনন্দ-আয়োজন।

প্যারেডের মূল আকর্ষণ থাকে বিশালাকৃতির এক একটি বেলুন। টার্কি,কর্নেকোপিয়া,পামকিন,সান্তা ক্লজের বেলুনগুলো হয় আকাশ ছোঁয়া। কার্টুন চরিত্র স্পাইডার ম্যান,ডোড়া,স্পঞ্জপাপ,টিনেজ মিউটন নিঞ্জা টারটেল,ডাইরি দ্যা উইম্পি কিডস,হ্যালো কিটি,মিকি মাউস,কুংফু পান্ডা,পল ফ্রেংক,মিনিয়েম,এডভেঞ্চার টাইম,কেডিফিলার,টমাস দ্যা ট্রেন ইত্যাদি চরিত্রের বেলুনও থাকে দেখার মতো।

বিখ্যাত সব সেলিব্রেটির উপস্থিতি ও পরিবেশনা এই প্যারেডকে করে তোলে রঙিন। ছেলে বুড়ো সবাই উপভোগ করে এই প্যারেড।

'থ্যাংকস গিভিং ডে'র সাথে একেবারে পাশাপাশি অবস্থান করছে আরেকটি ‘ব্যতিক্রমী’ উৎসব। ধন্যবাদ দেয়ার পরের দিনই পালিত হয় ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। এর সাথে অবশ্য এক ধরনের বাণিজ্যিক বিষয়ও জড়িয়ে আছে।

'ব্ল্যাক ফ্রাই ডে'র এক রাতে আমেরিকা জুড়ে বিভিন্ন পণ্য যতটা বিক্রি হয়, মনে হয় না সারা বছরে আর কোন দিনে এতটা হয়। কাপড় থেকে শুরু করে কম্পিউটার, টেলিভিশন থেকে শুরু করে গৃহস্থালি, সবকিছু পাওয়া যায় অবিশ্বাস্য ছাড়ে !

মূলত রাতেই এসব পণ্য বিক্রি হয়। আর সারা রাত ধরে খোলা থাকে বিভিন্ন শপিংমল ও চেইন স্টোর। মানুষজনও দলে দলে বের হয়ে পড়ে এই রাতে। কম দামে জিনিস পেতে লম্বা লাইন পড়ে যায় বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর কিংবা শপিং মলে। সেই লাইনও হয় দেখার মতো।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, উৎসব-আয়োজনে বাংলাদেশে কারসাজি করে বাড়িয়ে দেয়া হয় জিনিসপত্রের দাম, আর যুক্তরাষ্ট্রে পুরোপুরি উল্টো। কোন উৎসবকে সামনে রেখেই বরং দেয়া হয় 'সেল'।

শীত এলে কমে যায় শীত বস্ত্রের দাম। তাও আবার অনেক বেশি মূল্য হ্রাস করা হয়। যেন সবাই কেনাকাটার মধ্য দিয়ে উৎসবে যুক্ত হতে পারে। সত্যিই হৃদয় উষ্ণ করা উৎসবই বটে !

লেখক: ইয়োগা আর্টিস্ট, লেখক ও উপস্থাপক।

ইমেইল: Leuza.yoga@gmail.com