জাতীয় পার্টিতে গৃহবিবাদের মধ্যে রওশন এরশাদ অনুসারীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। মনোনয়ন ফরম নেননি রওশন নিজেও। তার ছেলে সাদ এরশাদের রংপুর-৩ আসন দেওয়া হয়েছে জি এম কাদেরকে।
Published : 29 Nov 2023, 07:56 PM
মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে বিভক্তি ও অসন্তোষের মধ্যে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদপন্থিরা বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার আগের রাতে এই বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন রওশন এরশাদ নিজেও।
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার অনুসারী ও রংপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়া মশিউর রহমান রাঙ্গা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, “নির্বাচনে আমরা যাব, কীভাবে যাব সেই বিষয় নির্ধারণ করতেই আজকে বৈঠক।…আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আসছেন, তিনি আসলে আমরা সবাই একটা সিদ্ধান্ত নেব, এর আগে কিছু বলা যায় না।”
গত সোমবার জাতীয় পার্টি যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে, সেখানে ঘোষণা করা হয় ২৮৭টি নাম।
রওশনের জন্য ময়মনসিংহ-৪ ফাঁকা রাখল জাতীয় পার্টি
গৃহবিবাদ নিয়েই ভোটে জাতীয় পার্টি
রওশন এরশাদের জন্য ময়মনসিংহ-৪ আসন ফাঁকা রাখা হয় তাকে সম্মান দেখানোর কথা বলে। বাকি আসনগুলোতে যোগ্য প্রার্থী না থাকার কথা জানানো হয় দলের পক্ষ থেকে।
এই প্রার্থী তালিকা জাতীয় পার্টির ভেতরের বিভক্তিকে আরও উসকে দিয়েছে।
রওশন এখনও দলের মনোনয়ন ফরম তোলেননি। ফরম তোলেননি তার ও এরশাদের ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদও, যিনি রংপুর-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য।
দলের প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত বহু নেতা। মশিউর রহমান রাঙ্গার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে রাজি নন জি এম কাদের, তাকে মনোনয়নের তালিকাতেও বিবেচনায় আনা হয়নি। অথচ রংপুর-১ আসনে তিনি লাঙ্গল নিয়ে তিনবার জিতেছেন।
দলে ফেরানো হয়নি রওশনপন্থি নেতা জিয়াউল হক মৃধাকেও। মনোনয়ন পাননি পিরোজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী, যিনি ১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে চার চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু মনোনয়ন ফরম ছাড়ার পর থেকেই বলে আসছেন রওশন তিনটি আসনের জন্য ফরম চেয়েছেন। এর একটি ছেলে সাদ এরশাদের জন্য, একটি ময়মনসিংহের বহিষ্কৃত নেতা কে আর রহমানের জন্য।
বিরোধীদলীয় নেতা চাইলে তার বাসায় গিয়ে ফরম দিয়ে আসবেন- এমন কথাও বলেছেন একাধিকবার।
রওশন নির্বাচন থেকে পুরোপুরি দূরে সরে আছে, যিনি ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন থেকেই হয়ে উঠেছেন গুরুত্বপূর্ণ। টানা দুই মেয়াদে বিরোধীদলীয় নেতাও তিনি।
তাকে ও তার অনুসারীদের বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় কতটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে, তা নিয়েও আছে সংশয়।
জাতীয় পার্টি নিয়ে পুরনো অংকেই আওয়ামী লীগ
২৮৭ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী ঘোষণা
স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন রাঙ্গা, জাতীয় পার্টিকে বললেন ‘পরগাছা’
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাকে রংপুর-১, ছেলে সাদ এরশাদকে রংপুর-৩ আসনসহ অনুসারীদের জন্য আরও কিছু আসন চেয়েছেন রওশন।
কিন্তু জাতীয় পার্টি রংপুর-১ আসনে প্রার্থী করেছে জি এম কাদেরের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারকে। জি এম কাদের নিজে দাঁড়াবেন রংপুর-৩ আসনে।
রওশন ও তার অনুসারীদের দৃশ্যত কোনো সুযোগ দিচ্ছেন না জি এম কাদের। মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আশাবাদী উনারা (রওশন অনুসারী) আমাদের সঙ্গে আসবেন। শুধু অপেক্ষায় আছি না, উনাদের জন্য মনোনয়ন ফরম নিয়ে অফিসে বসে আছি।”
জাতীয় পার্টিতে কর্তৃত্ব নিয়ে এই দ্বন্দ্ব চলছে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে। দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সেনা শাসক এরশাদ যতদিন বেঁচে ছিলেন, বিভেদটা ছিল মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কের গতি প্রকৃতি নিয়ে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরের নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনে যায় বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে জাতীয় পার্টির দ্যোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন রওশন।
সেই নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দিলেও পরে প্রার্থিতা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন দলে রওশনকে ঘিরে তৈরি হয় আরও একটি বলয়। তারা জানান, ভোট করবেন।
জি এম কাদের সে সময় তার ভাইয়ের নির্দেশ মেনে ভোট থেকে দূরে ছিলেন। তবে এরশাদের মনোনয়নপত্র ঢাকা থেকে প্রত্যাহার হলেও রংপুর-৩ ও লালমনিরহাট-১ আসনে থেকে যায়।
ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে সেই নির্বাচনে এরশাদকে রংপুর থেকে জয়ী ঘোষণা করা হয়, পরাজিত দেখানো হয় লালমনিরহাটে।
এরশাদ প্রথমে বলেন, তিনি শপথ নেবেন না। তবে তার আগেই জাতীয় পার্টির ৩৪ জন সংসদ সদস্যের বেশিরভাগের পছন্দে রওশন এরশাদ সংসদীয় দলের নেতা-নির্বাচিত হন এবং তাকে বিরোধীদলীয় নেতা করা হয়।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাস ছয়েক পর এরশাদের মৃত্যু হয়; জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হয় বিভেদ। একদিকে রওশন এরশাদ এবং অন্যদিকে জি এম কাদের। শেষ পর্যন্ত কাদেরপন্থিরাই ‘লড়াইয়ে’ জেতেন। জি এম কাদের হন চেয়ারম্যান, প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন রওশন।
৩ জনের জন্য ফরম ‘চেয়েছেন’ রওশন, বাসায় নিয়ে যাবেন চুন্নু
রওশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বেশ ভালো। তবে জি এম কাদের নানা সময় সরকারের কট্টর সমালোচনা করেছিলেন, এমনকি ভোটে আসা নিয়েও তার অন্য চিন্তা ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে।
থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদের নামে গত বছরের ৩০ অগাস্ট আকস্মিকভাবে দলের কাউন্সিল ডাকা হয়। এর পাল্টায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরাও রওশনকে বাদ দিয়ে কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে সেপ্টেম্বরের শুরুতে চিঠি দেন স্পিকারকে।
এর পাল্টায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরাও রওশনকে বাদ দিয়ে কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে সেপ্টেম্বরের শুরুতে চিঠি দেন স্পিকারকে।
সেই বিরোধের মধ্যে দেবর-ভাবি দুজনে মিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন।
দবে জি এম কাদেরের দলীয় চেয়ারম্যান হওয়ার বৈধতা নিয়ে আদালতে মামলা আছে। রওশন অনুসারী হিসেবে পরিচিত জিয়াউল হক মৃধান এই মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।