“ঢাকায় মাত্র ২৫ লাখ টাকায় ভোট! কি যে বলেন, পঁচিশ লাখ টাকা তো এক দিনের খরচ। ঢাকায় একজন প্রার্থীর নির্বাচন ভালোভাবে করতে হলে ২৫ কোটি টাকা লাগে।"
Published : 05 Jan 2024, 05:52 PM
ঢাকা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাঈদ খোকনের প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী আকতার হোসেন। তার অভিযোগ, নির্বাচনে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচের যে সীমা বেঁধে দেওয়া আছে, ৩১ ডিসেম্বর মধ্যেই তার চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলেছেন সাঈদ খোকন।
নৌকার প্রার্থী আইনে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত টাকা ভোটের মাঠে খরচ করেছেন কি না, আকতার হোসেন তা কীভাবে বুঝলেন? ছড়ি প্রতীকের এই প্রার্থী বলছেন, কেবল পোস্টার দেখেই সেটা বোঝা সম্ভব।
“ঢাকার সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, ওয়ারী, কোতোয়ালি, বংশালের আংশিক নিয়ে বিশাল এই নির্বাচনী এলাকায় তার লক্ষ-লক্ষ লেমিনেটেড পোস্টার দৃশ্যমান। এছাড়া তার হাজার হাজার ব্যানার ও ফেস্টুন টানানো হয়েছে। সাঈদ খোকন নৌকার যে পোস্টার ঝুলিয়েছেন, তার প্রায় সবই লেমিনেটেড, প্রতিটার উৎপাদন খরচ প্রায় ৯ টাকা। দুই-আড়াই লাখ পোস্টার ছাপালেও তার ব্যয় সীমা পার হয়ে যায়।”
এই যুক্তি দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছেন জানিয়ে আকতার হোসেন বলেন, “কেউ কিছু দেখছে না, কোনো মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও নেই।”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পোস্টারের সংখ্যা এবং খরচের বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন সাঈদ খোকন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "আমি এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন থেকে এ ধরনের বিষয়ে কোনো তথ্য পাইনি। আমাকে কেউ কিছু বলেননি।"
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী দলীয় অনুদানসহ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী খরচ ২৫ লাখ টাকার বেশি হতে পারবে না। প্রার্থীরা নির্বাচনের পর ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসেব না দিলে দুই থেকে সাত বছরের জেল হতে পারে।
ভোটে জয়ের জন্য যারা প্রচারে জোর দেন, তাদের অনেকের খরচই যে ওই সীমার মধ্যে থাকে না, সেটা নিয়ে সাধারণের মনে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু ব্যয়সীমা লঙ্ঘন হল কি না, তা দেখার কোনো চেষ্টা বা উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন কখনো নেয় না। আইনে যাই থাক, ব্যয়সীমা অতিক্রম করায় কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নজির নেই।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলামের ভাষায়, প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব ‘একটি রিচুয়ালিস্টিক নীতিকথায়’ পরিণত হয়েছে।
“যার আছে, তিনি নির্বাচনের শুরু থেকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বহুগুণ বেশি খরচ করেন। যার নেই, যেটা লিমিট আছে এর অর্ধেকও তিনি খরচ করতে পারেন না। প্রার্থীর সামর্থ্যের ওপর এই খরচটা হয়ে থাকে। এটাকে মনিটর করা কিংবা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।”
পোস্টারে আসলে খরচ কত?
সাঈদ খোকনের পোস্টারের খরচ নিয়ে আকতার হোসেন যে অভিযোগ করেছেন, তার বাস্তবতা বুঝতে এ সপ্তাহে কয়েকটি প্রেসে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
ঢাকার ফকিরাপুল এলাকায় বেশ কিছু ছাপাখানা রয়েছে, যেখানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রার্থীরাও পোস্টার, লিফলেট ছাপিয়ে নিয়েছেন।
ছাপাখানা মালিক ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কোনো কোনো প্রার্থী এক লাখ পোস্টারও ছাপিয়ে নিয়েছেন, লিফলেট নিয়েছেন কয়েক লাখ।
বছরের শেষ আর শুরুর এই সময়ে ছাপাখানাগুলো মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, নোটপ্যাড ও পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজে ব্যস্ত থাকে। এর মধ্যে ভোটের পোস্টার যোগ হওয়ায় কাগজ ও ছাপার কাজে ব্যবহৃত রঙের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে খরচও বেড়েছে দফায় দফায়।
আইন অনুযায়ী, প্রার্থীরা নির্দিষ্ট মাপে সাদা কালো পোস্টার ছাপতে পারবেন। প্রেস মালিকরা বললেন, ভালো মানের কাগজে প্রতিটি পোস্টার ছাপার খরচ এবার পড়েছে চার থেকে সাড়ে চার টাকা।
আর যদি পানিরোধী লেমিনেশন (স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আবরণ দিয়ে মোড়ানো) করলে প্রতি পোস্টারের খরচ বেড়ে হয় সাড়ে ৭ থেকে ৮ টাকা।
শীতের এই সময়ে কুয়াশার দাপট থাকে বলে প্রায় সব প্রার্থীই লেমিনেশন করা পোস্টার টাঙিয়েছেন সর্বত্র। যদিও নির্বাচনী আচরণ বিধিতে তা নিষিদ্ধ।
ঢাকা-৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল ইসলাম স্বপনের পোস্টার ও লিফলেট ছাপানোর কাজ পেয়েছিল ফকিরাপুলের এশিয়া প্রিন্টার্স। এই প্রেসের স্বত্বাধিকারী আরিফুল হাসান জানান, মাছ প্রতীকের প্রার্থী মাত্র তিন হাজার পোস্টার ছেপেছেন। ১০ হাজার লিফলেটের শেষ বান্ডিল নিয়ে গেছেন গত বুধবার।
পোস্টার ছাপার খরচের হিসাব দিয়ে আরিফুল বলেন, ‘‘এবার কালির দাম দফায় দফায় বাড়ছে। ভালো মানের (১০০ জিএসএম) কাগজে এক হাজার পোস্টার ছাপতে খরচ হবে সাড়ে চার হাজার টাকা। ২০ হাজারের বেশি হলে তখন চার হাজার টাকা খরচ হয় প্রতি হাজারে। লেমিনেশন করলে পোস্টারের খরচ হয় প্রতি হাজার সাড়ে সাত হাজার থেকে আট হাজার টাকা।”
একই এলাকার আরেক ছাপাখানা ইউআর প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম জানালেন, তার প্রেস থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরল ইসলাম নাহিদের নির্বাচনি পোস্টার ছাপানো হয়েছে।
“দুই প্রার্থীর এক লাখ করে পোস্টার ছাপানোর অর্ডার পেয়েছিলাম। তাদের প্রতিনিধিরা নিয়ে গেছেন।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার টুঙ্গিপাড়া আসন থেকে প্রতিদ্বদ্বিতা করছেন। আর নুরুল ইসলাম নাহিদ নির্বাচন করছেন সিলেট-৬ আসন থেকে।
আসলাম প্রিন্টার্স থেকে ৫০ হাজার পোস্টার ছেপে নিয়ে গেছেন পিরোজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। ছাপাখানার মালিক আসলাম মিয়া বললেন, দাম বেশি পড়ায় এবার পোস্টারের অর্ডার কম পেয়েছেন।
গত বুধবার রাতেও ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবি তাজুল ইসলামের নৌকা প্রতীকের লিফলেট ছাপতে দেখা গেছে ফকিরাপুলের আল মনিকা প্রিন্টার্সে।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা বলেন, “উনার ৫০ হাজার পোস্টার আমরা ছেপেছি।’’
সুনামগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদের লিফলেট ছাপা হয়েছে ফকিরাপুলের এএম প্রিন্টার্সে। বুধার রাতেই ২০ হাজার লিফলেট ছেপে এলাকায় পাঠানো হয়েছে জানালেন প্রেস মালিক আশরাফুল আলম।
প্রার্থীরা সব পোস্টার লিফলেট এক প্রেস থেকেই ছাপবেন, এমন কোনো কথা নেই। আবার প্রার্থীর পক্ষে তার অনুসারী দলীয় নেতা, আত্মীয় বন্ধুরাও পোস্টার ছাপিয়ে দেন। ভিন্ন ভিন্ন প্রেস থেকে সেগুলো ছাপা হতে পারে। ফলে কোনো আসনে একজন প্রার্থীর নামে কত পোস্টার বা লিফলেট ছাপা হল, সেই সংখ্যা স্বাধীনভাবে যাচাই করা প্রায় অসম্ভব।
‘নিয়ম মেনেই’ খরচ, দাবি প্রার্থীদের
নির্বাচনে একজন প্রার্থীর খরচ কেবল পোস্টার বা লিফলেট ছাপানোতে সীমাবদ্ধ থাকে না। গণসংযোগের সুবিধার জন্য নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনি ক্যাম্প করা হয়, রাস্তায় রাস্তায় চলে মাইকিং। অনেকে এখন সোশাল মিডিয়ায় এবং বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যমেও ভোটের বিজ্ঞাপন দেন, সেখানে কত খরচ হয়, তার হিসাব কোথাও থাকে না।
মিছিল, সভা করতে এবং ভোটারের দুয়ারে দুয়ারে যেতে কর্মীবাহিনী লাগে, সে খরচও কম নয়। নির্বাচনি এজেন্টদেরও খরচ আছে, যাতায়াতের জন্য আছে যানবাহন ও জ্বালানি খরচ।
সব মিলিয়ে যে নির্বাচনি ব্যয়, সেটাই রিটার্নিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু কেউ কখনও নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত খরচের কথা স্বীকার করেছেন, এমন খবর কখনো আসেনি।
আগে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় প্রার্থীদের সম্ভাব্য খরচের খাতওয়ারি বিবরণ দিতে হত। এবার নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নথিতে সেই ফরমটি দেখা গেল না।
একজন প্রার্থী ভোট করতে যে খরচ করবেন, সেই টাকা কোথা থেকে আসবে, তাও মনোনয়নপত্রের একটি ফর্মে জানাতে হয়।
ঢাকা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাঈদ খোকন সেখানে জানিয়েছেন, ভোটে তিনি ২৫ লাখ টাকাই খরচের পরিকল্পনা করেছেন, আর সেই টাকা আসবে তার ব্যবসা থেকে। কোনো ধরনের ধারকর্জ বা অনুদান তার লাগবে না।
সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে যিনি নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছেন, সেই আকতার হোসেন তিন লাখ ১০ হাজার টাকা খরচের পরিকল্পনার কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন।
এর মধ্যে ঘরভাড়া থেকে তিনি পাবেন ৫০ হাজার টাকা; খালাতো ভাই এবং অনাত্মীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ হাজার করে মোট এক লাখ টাকা ধার করবেন; মামার কাছ থেকে দান হিসেবে নেবেন ৫০ হাজার টাকা; অনাত্মীয় আরেক ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা অনুদান পাবেন। এছাড়া নিজের দল সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সদস্যদের দেওয়া চাঁদা থেকে পাওয়া এক লাখ টাকা তিনি ভোটে খরচ করবেন।
কোন খাতে কত খরচ করার পরিকল্পনা করেছেন তা জানাতে না চাইলেও নৌকার প্রার্থী সাঈদ খোকন বলছেন, ২৫ লাখ টাকার মধ্যে নির্বাচনী ব্যয় সীমাবদ্ধ রাখা ‘অসম্ভব ব্যাপার নয়’।
“যেটা ধরে দেওয়া আছে, সেটার ভেতরে থেকেই আমাকে খরচ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প তো নেই।”
এ বিষয়ে আরো ডজনখানেক প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। দলমত নির্বিশেষে তারা সবাই একই সুরে কথা বলেছেন।
ঢাকা-৭ আসনে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির প্রার্থী মাসুদ পাশা বলেন, “নির্বাচনে আমার খরচ হবে লাখ খানেক টাকা। পোস্টার ছাপিয়েছি ৫০ হাজার; আমার খুব বেশি খরচ হবে না।”
ঢাকা-১১ আসনে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি-বিএসপি’র প্রার্থী (একতারা) ফারাহনাজ হক চৌধুরী বলেন, “আমি তো আম জনতার একজন। আমার সাধ্যমতো খরচ করছি। তবে সেটা খুব বেশি হবে না।”
একই আসনে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির প্রার্থী মিজানুর রহমান বলেছেন, নির্বাচনে তার খরচও ‘কয়েক লাখ’ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
“পোস্টার ছাপিয়েছি ৬ হাজার। লিফলেট ৬ হাজার, মাইকিং, বাজেট ২ লাখ। ১০ হাজার পোস্টার ছাপাতে পারলে ভালো হত। আবুল হোটেল থেকে ভাটারা থানা পর্যন্ত পোস্টার সাঁটিয়েছি। এবার জয়ের বিষয়ে আমি বেশ আশাবাদী,” বলেন মিজান।
প্রার্থীরা যে যাই বলুক, ২৫ লাখ টাকায় নির্বাচন হয় বলে মনে করেন না ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. খুরশেদ আলম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "নির্বাচন কমিশন যে ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনি খরচ ধরেছে, এটা একজন প্রার্থীর কয়েক দিনের খরচ। এর চেয়ে বহুগুণ অর্থ ব্যয় হয় একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর, আর এমপিদের তো হিসাবই নেই। আমি মনে করি এটা (ব্যয়সীমা) আরও অনেক বেশি দেওয়া দরকার।"
ঢাকায় এক প্রার্থীর প্রচারে দায়িত্বে আছেন, এমন একজন খরচের যে হিসাব দিলেন, তা খুরশেদের সঙ্গে মেলে।
“ঢাকায় মাত্র ২৫ লাখ টাকায় ভোট! কি যে বলেন, পঁচিশ লাখ টাকা তো এক দিনের খরচ। ঢাকায় একজন প্রার্থীর নির্বাচন ভালোভাবে করতে হলে ২৫ কোটি টাকা লাগে।"
খরচ দেয় ‘অন্যেরা’
ঢাকা-৭ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাজি সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন পরিচিত তার পোস্টারের কারণে। এর আগে বিভিন্ন সময় পোস্টার দিয়ে পুরো ঢাকা ছেয়ে ফেলায় কেউ কেউ তার নামের সঙ্গেই পোস্টার শব্দটি যুক্ত করে দিয়েছেন।
মিলন এবার ২৫ লাখ টাকাই খরচ করার পরিকল্পনা ইসিকে জানিয়েছেন। সেই অর্থ আসবে তার ব্যবসা থেকে। ধার বা দান নেওয়ার বিষয়ে ঘোষণার ঘর তিনি ফাঁকাই রেখেছেন।
তবে তার ভোট করতে যে অন্যের পকেটের টাকাও খরচ হবে, সে কথা তিনি স্বীকার করলেন অবলীলায়।
“প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ হাজার লোক আমার গণসংযোগে অংশ নিচ্ছে। ৫০০ জনের বেশি মহিলা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই আমার পক্ষ হয়ে খরচ করছে। প্রতিটা অলিগলিতে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে আমার পক্ষে প্রচারে আছে। নির্বাচনে আমার ২০/২৫ লাখ টাকা খরচ হবে। বন্ধু স্বজনরা নিজ খরচে চা-বিস্কুট খায়। তারাই ১০০ জন ২০০ জন লোক নিয়ে আসে।”
এ প্রার্থীর মতে, নির্বাচনি খরচের যে সীমা দেওয়া হয়েছে, সেটা ‘ঠিক আছে’।
“ভোট কিনতে গেলে টাকা বেশি খরচ হবে। ভোট না কিনলে তো এত টাকা লাগার কথা না। সরকারি দলের প্রার্থী বেপরোয়া টাকা খরচ করতেছে। তারা বিশাল বিশাল পোস্টার ফেস্টুন লাগিয়ে রেখেছে। আমি মাত্র আড়াই লাখ টাকার পোস্টার ছাপিয়েছি। পোলিং এজেন্টদের ৫০০ টাকা করে দেব। যারা আমার আত্মীয়-স্বজন তাদের তো টাকা দিতে হবে না।”
মিলন বলেন, “পোস্টার আমার দুই বন্ধু দিয়েছে। লিফলেট দিয়েছে এক বন্ধু। আমার বেশি খরচ নাই। বন্ধুরা যেসব লোক নিয়ে আসে, তারাই খরচ করে। সব কিছু ধরলে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে বলে আমার ধারণা।”
ভোট করতে আত্মীয়-বন্ধুদের এমন ‘সাহায্য’ পাওয়ার কথা আরো অনেক প্রার্থীই বললেন। তাদের একজন ঢাকা-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সজল মোল্লা।
তিনি বলেন, "নির্বাচন কমিশন যে খরচটা ধরেছে, আমার ব্যক্তিগত নির্বাচনী খরচ এর মধ্যেই হবে বলে আশা করছি। কারণ আমার বহু ঘনিষ্ঠ লোকজন আছেন, যারা নিজেরা যেখানে যা লাগছে, দিচ্ছে। তবে এই খরচটা আরেকটু বাড়ালে অনেক প্রার্থীর জন্য ভালো হত।"
প্রার্থীদের এ ধরনের খরচের বিষয়ে ঢাকা-৭ আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আতাহার মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এক প্রকার অসহায়ত্বই প্রকাশ করলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেক কিছু চিহ্নত করা জটিল হয়। অনেক সময় প্রার্থীর বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নেমে খরচ করে। সে ক্ষেত্রে আমরা বিষয়টি কোনো ফরম্যাটে ফেলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ি। তবে বড় কোনো ব্যয়ের বিষয় চোখে পড়লে আমরা অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।”
নিয়ম যেন ‘কথার কথা’
প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব নিয়ে যে কেবল সাধারণ মানুষের প্রশ্ন আছে, তা নয়। একজন বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনারও এ বিষয়ে নিঃসংশয়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রার্থীকে তার ব্যাংক হিসাব থেকে খরচ করে সেটার স্টেটমেন্ট নির্বাচন কমিশনকে দিতে বলা হয়েছে। একজন প্রার্থী কত পোস্টার ছেপেছে, সেটার বিল জমা দেবে। কয়টা নির্বাচনী অফিস করতে পারবে, কয়টা মাইক্রোবাস ব্যবহার করবে, সেটার হিসাব দেবে।
“কিন্তু ইলেকশন কমিশন এগুলো নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না। কারণ এর বাইরেও অনেক খরচ চোখে পড়ে। আত্মীয় স্বজন খরচ করলেও সেটা সার্বিকভাবে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছে। সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে।”
নির্বাচনী ব্যয় নিয়ে নানা ধরনের ‘ফাঁকফোকরের’ কথা উঠে এল একাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করা নির্বাচন কমিশনের সদস্য মো. রফিকুল ইসলামের কথায়।
তিনি বলেন, “বাড়তি খরচের বিষয়ে প্রার্থীরা নানা রকম যুক্তি দেয়। কখনও বলে আমি খরচ করিনি, আমার সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষীরা খরচ করেছে। কখনো বলে আমি মাইকিং করতে চাইনি, আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা করেছে। দেখা যাচ্ছে, পোস্টারের প্রসঙ্গে তারা বলে যে, আমি পোস্টার ছাপাইনি, আমাদের পক্ষে কেউ ছাপিয়ে দিয়েছে। আমার কোনো খরচ লাগেনি, আমি খরচ দেখাব কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।
“কিন্তু প্রচারের খরচ মনিটর ও অ্যাসেস করার মত কোনো ক্যাপাবিলিটি কমিশনের ডেভেলপ করে নাই। ফলে এটা একটা রিচুয়ালিস্টিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা থাকা না থাকা বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সমান।”
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথের বক্তব্য ঢাকা-৭ আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার মতই। তিনিও বললেন, নির্বাচনী ব্যয় তদারকি ‘একটা খুব জটিল বিষয়’।
“দৃশ্যমান খরচগুলো সহজেই ধরা যায়। কিন্তু অদৃশ্য কোনো ব্যয় করলে তা ধরা বেশ কঠিন। এরপরও কোনো ধরনের অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা নেব। নির্বাচনী এলাকায় রিটার্নিং কর্মকর্তার নজরে এলে নির্বাহী হাকিম ও বিচারিক হাকিম এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পরে। ইসির কাছে অভিযোগ করলে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটিকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা যায়।”
আরো পড়ুন
নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী
জানুয়ারি মাসের মধ্যে নির্বাচনী ব্যয় বিবরণী দাখিলের নির্দেশ
হিসাব না দেয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ইসির মামলার নির্দেশ
নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব যথাসময়ে না দেওয়ায় সাইফুরের বিরুদ্ধে মামলা