প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হিসেবে জি এম কাদেরের নাম জমা পড়েছে ইসিতে। তবে তাকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা রওশন এরশাদও চিঠি দিতে যাচ্ছেন।
Published : 29 Jan 2024, 12:13 AM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে নতুন বিবাদে আসন্ন দুই সিটি করপোরেশন ও উপজেলা নির্বাচনে দলটির ভূমিকা কী হবে, তা আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
রোববার জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ও মুজিবুল হক চুন্নুকে মহাসচিবের পদ থেকে বহিষ্কার করে রওশন এরশাদের নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করার পর সামনের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে কারা লাঙ্গলের প্রার্থী দেবেন, সেটি নিয়ে দেখা দিতে পারে বিরোধ।
মুজিবুল হক চুন্নু এরই মধ্যে জি এম কাদের মনোনয়নের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি- এমনটা জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন।
অন্যদিকে রওশন যাকে মহাসচিব ঘোষণা দিয়েছেন, সেই মামুনুর রশীদ বলেছেন, তারাই প্রকৃত জাতীয় পার্টি। নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন।
জাতীয় পার্টির এই বিভেদের মধ্যে আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এবং আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আরও নাটকীয় ঘটনা ঘটার আভাস দেখতে পাচ্ছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
যদি রওশন এরশাদ প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং জি এম কাদেরের নেতৃত্বে কমিটি প্রার্থী দেয়, তাহলে কোনটা বৈধ হবে- এই প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাছে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব হিসেবে বর্তমান কমিটির নাম রয়েছে। সামনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে তাদের চিঠিই মুখ্য।
“নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ সংক্রান্ত কোনো চিঠি আমাদের কাছে আসেনি। কোনো নালিশ বা চিঠি এলে তা তখন যাচাই বাছাই করে নিষ্পত্তি হবে।”
জাতীয় পার্টির যতরূপ
১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর জন্ম নেওয়া জাতীয় পার্টি ১৯৯০ সালে তার পতনের পর থেকে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু।
১৯৯৬ সালের পর এরশাদের দলে ভাঙন ধরে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা হয়ে যান। তার দলের নাম জাতীয় পার্টি (জেপি)
এরশাদ ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে গঠন করেন চারদলীয় জোট। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে আগে সেই জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বড় ভাঙনের শিকার হয় জাতীয় পার্টি।
নাজিউর রহমান মঞ্জু ও এম এ মতিনের নেতৃত্বে গঠন হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি। এই দলটি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে যায়। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিজেপি বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে।
এই বিজেপিও পরে ভেঙেছে। ভেঙেছে এরশাদের জাতীয় পার্টিও।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে মতবিরোধ থেকে জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব কাজী জাফর আহমেদ দল থেকে বেরিয়ে একই নাম, প্রতীক ও লোগো নিয়ে দলের ঘোষণা দেন।
২০১৫ সালে কাজী জাফরের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পান এরশাদের জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী টি আই এম ফজলে রাব্বি চৌধুরী, মহাসচিব হন মোস্তফা জামাল হায়দার। দলটি এখনও নিবন্ধন পায়নি।
ফজলে রাব্বি চৌধুরীও মারা গেছেন।
তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ‘লাঙল’ প্রতীক ধরে রাখেন এরশাদ। ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয় দলটি।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি-জেপি একই বছরের ২০ অক্টোবর নিবন্ধন পায়, দলীয় প্রতীক হয় বাই সাইকেল।
নাজিউরের মৃত্যুর পর বিজেপিও ভাঙে। তার ছেলের আন্দালিব রহমান পার্থ নেতৃত্বাধীন বিজেপি নিবন্ধন পায় একই বছরের ৯ নভেম্বর, প্রতীক পায় গরুর গাড়ি।
এম এ মতিন আগেই আলাদা বিজেপি গঠন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর মেয়ে তাসমিনা মতিনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি কাঁঠাল প্রতীক পেয়ে একই বছর ১৬ নভেম্বর ইসিতে নিবন্ধন পায়। বর্তমানে দলের চেয়ারম্যান এম এ মুকিত।
২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর জাপা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব জিএম কাদের নেওয়ার পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। একাধিকবার নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন এরশাদপত্নী রওশন।
সবশেষ ২০২৩ সালের অগাস্টে ভারত সফরে থাকা জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন রওশন। পরে অবশ্য বিরোধ মিটে যায়।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে নতুন করে বিভক্তি দেখা দেয়; রওশন ও তার পুত্র মনোনয়নপত্রই নেননি।
দলে বিভক্তি, মনোনয়ন দেবেন কে
রোববার মুজিবুল হক চুন্নু স্বাক্ষরিত দুটি চিঠি দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনে।
একটি চিঠিতে স্থানীয় সরকারের ভোটে প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নাম দেওয়া হয়েছে। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিষয়ে দেওয়া হয়েছে অপর চিঠিটি।
রওশন যাকে মহাসচিব ঘোষণা করেছেন, সেই মামুনুর রশীদ বলেন, “আমরা জাতীয় পার্টির নতুন কমিটির কথা কমিশনকে জানাব। দল থেকে কাউকে বহিষ্কার করা হয়নি। সেক্ষেত্রে সংসদ সদস্য পদ বা নিবন্ধন নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না।”
নতুন করে ‘নালিশ’ এলে কমিশন দুই পক্ষের আবেদন যাচাই-বাছাই করে বা শুনানি করে সিদ্ধান্ত দিতে পারে।
গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ জোট করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিলেও তারা তা আমলে নেয়নি। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের চিঠিই আমলে নিয়েছিল।
এবার কী সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন?-এই প্রশ্নে কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইন-বিধি মেনে নিষ্পত্তি করা হবে। বিদ্যমান কমিটির তথ্যই ইসির কাছে রয়েছে।”
ভাঙনের মধ্যে জাতীয় পার্টির নাম ব্যবহার করে নতুন দলের নিবন্ধন পেতে হলেও অন্তত সাড়ে চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের অন্তত ছয় মাস আগে নতুন দল নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি।
পাল্টাপাল্টি বক্তব্য
জাতীয় নির্বাচনে ভোট শেষে তিন সপ্তাহের মাথায় রোববার গুলশানের নিজের বাসায় সভা করে রওশন নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করে জিএম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক চন্নুকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়ার কথা বলেন।
তিনি বলেন, “পার্টির ভালোর জন্য, পার্টির ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমি নিজে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলাম এবং পরবর্তী কাউন্সিল না হওয়া পর্যন্ত কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদান করলাম। তিনি সার্বিকভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।”
পরে চুন্নু পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, তাকে এবং জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়ার যে ঘোষণা রওশন এরশাদ দিয়েছেন, সেটি তিনি পারেন না।
চুন্নু বলেন, “এবারই প্রথম নয়, (রওশনের ঘোষণা) এটা তৃতীয়বার। এর আগেও দুইবার তিনি এইরকম বাদ দিয়ে নিজেই চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। পরবর্তীতে প্রত্যাহার করেছেন।
“এটার কোনো ভিত্তি নাই। এটা অগঠনতান্ত্রিক, এ ধরনের কোনো ক্ষমতা উনার নাই। এই বিষয়টা আইনের ভাষায় যেটা বলে আমরা এটা আমলে নিচ্ছি না।”
‘অব্যাহতির’ ঘোষণা আমলে নিচ্ছেন না চুন্নু
নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা রওশনের
জি এম কাদেরকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে ‘চেয়ার’ নিলেন রওশন
জাতীয় পার্টি থেকে বাদ কাজী ফিরোজ ও সুনীল শুভরায়
জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে রওশনের ‘নালিশ’