ঘরে বিবাদ, স্পিকারের দিকে তাকিয়ে জাপা

কাউন্সিল ডেকেছেন রওশন এরশাদ; পাল্টায় তাকে বাদ দিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে চাইছেন দলটির নেতারা।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2022, 05:01 PM
Updated : 6 Sept 2022, 05:01 PM

রওশন এরশাদকে সরিয়ে জি এম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে জাতীয় পার্টি।

রওশনের আকস্মিক পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ নিয়ে এখন স্পিকারের সিদ্ধান্ত দেখে নিজেদের পরের পদক্ষেপ ঠিক করতে চান দলটির নেতারা।

দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে উপেক্ষা করে প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশনের কাউন্সিল ডাকার পেছনে দলের বাইরের ইন্ধনও দেখছেন তারা।

এদিকে অসুস্থ রওশন চলতি মাসেই থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।

গত ৩০ অগাস্ট রওশন এরশাদের নামে একটি বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। তার সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতার কার্যালয়ের প্যাডে রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহর নামে একটি চিঠিও ছিল।

তিন পৃষ্ঠার ওই বিজ্ঞপ্তিতে দলের ভেতরকার রাজনীতির নানা বিষয় বর্ণনা করে আগামী ২৬ নভেম্বর দলের সম্মেলন আহ্বান করেন রওশন। নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি কমিটিরও ঘোষণা দেন।

রওশনের আচমকা এ ঘোষণায় জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব প্রথমে কোনো মন্তব্য না করলেও পরে দলের চেয়ারম্যানের প্রেস সচিব খন্দকার দোলোয়ার জালালী একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, দলের কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার রওশনের নেই। তার পদক্ষেপ ‘অবৈধ’।

রওশনের ওই পদক্ষেপের পাল্টায় পরদিনই তাকে সংসদে বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেন দলটির সংসদ সদস্যরা। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গত ১ সেপ্টেম্বর তাদের সিদ্ধান্ত জানান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে। পরে দলের প্রধান হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁও চিঠি দেন স্পিকারকে।

দলের ২৬ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে রওশন এরশাদ এবং তার ছেলে সাদ এরশাদ ছাড়া বাকি ২৪ জন রওশনকে বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত। এছাড়া দলের ৪১ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর ৩৯ সদস্যও জি এম কাদেরের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন।

সাধারণত দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কোনো সিদ্ধান্ত নিলে স্পিকার সেটি অনুমোদন করেন। এখন বিষয়টি স্পিকারের হাতে।

জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের একটি চিঠি আমি পেয়েছি। কোনো সিদ্ধান্ত আসলে সবাই জানতে পারবে।”

কবে নাগাদ স্পিকারের সিদ্ধান্ত জানা যাবে- জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, “দেখি। সিদ্ধান্ত হলে সবাই জানতে পারবেন।”

এদিকে বুধবার ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) আয়োজনে নারী স্পিকারদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে তাসখন্দ যাচ্ছেন শিরীন শারমিন। পাঁচ দিন পর দেশে ফিরবেন তিনি।

জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্পিকারের সিদ্ধান্ত জানা গেলে তারা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “আসলে একটা মহল রওশন এরশাদকে সামনে রেখে কিছু করতে চাইছে। তবে তারা দলের ভেতরের কেউ নন বা দলীয় পদে আছেন এমন কেউ নন। না হলে সংসদীয় দলের বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য একমত আসত না। তাছাড়া দলের ভেতরেও রওশনের কাউন্সিল ডাকা নিয়ে কোনো তৎপরতা নেই।”

এর মধ্যে এক সভায় জি এম কাদেরও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’র কথা বলেন। তবে তিনি একই সঙ্গে বলেন, কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ সফল হবে না।

ভাবি রওশন এরশাদের সঙ্গে দেবর জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব অনেক দিনের। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নানা বৈঠকে দু’জন বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। নানা কৌশলে তাদের মানাতেন দলের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে ছিলেন এরশাদ। ভোটের আগে তিনি নাটকীয়ভাবে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে রওশনের নেতৃত্বে একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপিবিহীন সেই সংসদ থেকে বিরোধীদলীয় নেতার আসনে রওশন।

এরশাদের মৃত্যুর পর জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলে রওশন তাতে আপত্তি তোলেন। এরশাদের আসনে উপ-নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে সেই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়।

এরপর জি এম কাদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ পাওয়ার জন্য স্পিকারকে চিঠি দিলে বিভেদ আরও বাড়ে। এক পর্যায়ে দলের একটি অংশ রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে জাতীয় পার্টি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়।

ওই সময় দুই পক্ষের নেতাদের সমঝোতা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জি এম কাদেরই পার্টির চেয়ারম্যান থাকবেন। আর রওশন হবেন বিরোধীদলীয় নেতা।

তবে তখন যারা রওশনের সঙ্গে ছিলেন, তাদের অনেককে এখন সেই পক্ষে দেখা যাচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক সংসদ সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পল্লীবন্ধু এরশাদ মারা যাওয়ার পর আমরা ম্যাডামের (রওশন) পক্ষে ছিলাম। দল ভাঙার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। আমরা অনেকেই সেবার রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য কাজ করেছিলাম।

“কিন্তু এবার হঠাৎ করে উনার নাম ব্যবহার করে যেটা করা হল, সেটা একদমই ঠিক হয়নি। আর তিনি যে কাউন্সিল ডাকলেন, সেটা কি তিনি পারেন? তিনি প্রধান পৃষ্ঠপোষক। একটা আলঙ্কারিক পদ।”

রওশনের কাউন্সিল ডাকা, জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকারকে চিঠি পাঠানোসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিডিনিউজ টোয়ৈন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা স্পিকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। তার সিদ্ধান্ত পেলে পরের কর্মসূচি ঠিক করা হবে।

“আমরা আশা করি, স্পিকার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মনোভাব বুঝে সিদ্ধান্ত দেবেন। তাছাড়া সংসদ নেতা দেশে নেই। স্পিকার এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সাধারণত সংসদ নেতার সঙ্গে পরামর্শ করেন।”

রওশনকে ঘিরে দলের ভেতরের কেউ তৎপরতা চালাচ্ছে কি না- জানতে চাইলে চুন্নু বলেন, “যাদের নাম আপনারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে লিখছেন, তারা কি দলের কেউ? দলে কোনো পদ আছে?

“দলের বাইরে থেকে কেউ কেউ এসব তৎপরতা চালাচ্ছে। আর এই যে ম্যাডামের নাম ব্যবহার করে কাউন্সিল ডেকে দিল, এটা বেআক্কেলের মতো কাজ হয়েছে। এরকম শিশুসুলভ কাজ হাস্যকর।”

এরশাদের গড়া দল জাতীয় পার্টি ভেঙেছে বেশ কয়েকবার। দলটির সাবেক মহাসচিবদের নেতৃত্বে আলাদা তিনটি দল এখনও সক্রিয় রয়েছে।

অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন বিদেশে থাকা রওশন গত বছর দেশে ফিরে দল নিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। গত সপ্তাহে তার নামে আসা চিঠিতে আগামী নভেম্বর মাসে দলের কাউন্সিল ডাকা হয়।

রওশন এরশাদ কাউন্সিলের প্রস্তুতির জন্য নিজেই আহ্বায়ক হয়ে কমিটি গঠনের কথা জানান চিঠিতে। দ‌লের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ ছয়জন কো-চেয়ারম্যানকে করেন যুগ্ম-আহ্বায়ক।

তবে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের প্রেস সচিবের বিবৃতিতে দাবি করা হয়, মহাসচিব চুন্নুসহ কো-চেয়ারম্যানরা ওই কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির বিষয়ে কিছু জানেন না।

৫ সেপ্টেম্বর নতুন করে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে সাতজন যুগ্ম আহ্বায়কের নাম ঘোষণা করেন রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। তারা হলেন- এম এ সাত্তার, দোলোয়ার হোসেন, এস এম এম আলম, এম এ গোফরান, জিয়াউল হক মৃধা, ইকবাল হোসেন রাজু ও কাজী মামনুর রশীদ।

এই সাতজনের মধ্যে শুধু জিয়াউল হক মৃধা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। বাকিদের দলে কোনো পদ নেই।

৮০ বছর বয়সী রওশন ফুসফুসের জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) টানা ৮৪ দিন থাকার পর গত বছর থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন।

ছয় মাস পর গত জুন মাসে দেশে ফিরে সংসদের বাজেট অধিবেশনে যোগ দেন তিনি। এরপর ৪ জুলাই আবার ব্যাংকক ফিরে যান চিকিৎসার জন্য।

চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই রওশন দেশে ফিরতে পারেন বলে জানিয়েছেন তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়ৈন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আশা করছি এ মাসের শেষ নাগাদ তিনি দেশে ফিলে আসবেন।”

রওশনের কাউন্সিল ডাকার বিষয়ে তিনি বলেন, “ম্যাডাম তার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। কাউন্সিল নিয়ে প্রস্তুতি চলছে।”