জাতীয় পার্টির এই দুই সংসদ সদস্যকে বিরোধী দলের নেতা ও উপনেতার স্বীকৃতি দিয়েছেন স্পিকার।
Published : 28 Jan 2024, 05:52 PM
দ্বাদশ সংসদে বিরোধী দল কারা হবে সেই আলোচনার মধ্যে জাতীয় পার্টির নেতা জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে উপনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
রোববার সংসদ সচিবালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এ খবর জানানো হয়।
স্বতন্ত্রদের জয় জয়াকারের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সংসদে বিরোধী দলের আসনে জাতীয় পার্টি না কি স্বতন্ত্র কারা বসবে রাজনীতিতে সেই প্রশ্নের সুরাহা হল স্পিকারের এ স্বীকৃতির পর।
এতে করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার নির্বাচনের পর দলগতভাবে ১১ আসন নিয়ে দ্বাদশ সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে বিরোধী দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি। আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও দলটির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে স্পিকার যথাক্রমে বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতার স্বীকৃতি দিলেন।
এমন এক দিনে নতুন সংসদে বিরোধী দল কারা হচ্ছে সেই প্রশ্নের উত্তর জানা গেল যেদিন জাতীয় পার্টির দলীয় রাজনীতি নিয়ে নতুন করে নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে।
রোববার দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও একাদশ সংসদের বর্তমান বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। পাশাপাশি তিনি দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেন।
এরপর দুপুরে বনানীতে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসে চুন্নু তা আমলে না নেওয়ার কথা বলেন।
এদিন বিকালেই সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও উপনেতার বিষয়ে সংসদ সচিবালয়ের প্রজ্ঞাপন এল।
এতে বলা হয়, "সংসদে সরকারি দলের বিরোধীতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসঙ্ঘের নেতা রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) সংসদে কাযপ্রণালী বিধি অনুযায়ী বিরোধী দলীয় নেতা ও চট্টগ্রাম-৫ আসনের সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে স্পিকার স্বীকৃতি দিয়েছেন।"
জাতীয় পার্টিও এর আগে গত ১৮ জানুয়ারি সংসদীয় দলের বৈঠকে এই দুইজনকে বিরোধী দলের নেতা ও উপনেতা নির্বাচন করে। পরে এ সংক্রান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত স্পিকারের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচিত দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের সংসদীয় দলের মনোনয়নের চিঠি পাওয়ার পর স্পিকার তাতে সম্মতি দিলে বিরোধ দল এবং বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতার বিষয়টি কার্যকর হয়।
তবে এবার পরিস্থিতি ছিল অন্যবারের চেয়ে ভিন্ন। স্বতন্ত্ররা চমক দেখিয়ে ৬২টি আসনে জয়ী হলে প্রধান বিরোধী দল কারা হবে তা নিয়ে নতুন আলোচনা তৈরি হয়।
বিএনপির বর্জনের ৭ জানুয়ারির ভোটে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসন পেয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। দলগতভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। এছাড়া জাসদ ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১ টি, এক সময়ে বিএনপি জোটে থাকা কল্যাণ পার্টি ১টি করে আসন পায়।
আর ৬২টি আসনে জয়ী হয়ে স্বতন্ত্ররা জোট গঠন করলে সংসদে বিরোধী দলের আসনে কারা বসবে সেই প্রশ্নে জাতীয় পার্টির বিষয়টিও সামনে আসে।
নতুন সংসদ সদস্যরা ইতোমধ্যে শপথ নিয়েছেন। ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে বসবেন তারা।
সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা মন্ত্রী এবং উপনেতা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পান। ‘বিরোধী দলীয় নেতা এবং উপনেতা (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) অধ্যাদেশে তাদের সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ করা রয়েছে। সংসদ ভবনে বিরোধী দলীয় নেতা ও উপনেতার পৃথক কার্যালয়ও রয়েছে।
সবশেষ একাদশ সংসদে জাপার তৎকালীন চেয়ারম্যন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা ও জি এম কাদের রিরোধীদলীয় উপনেতা ছিলেন।
বিতর্কের মধ্যেই বিরোধী দলীয় নেতা মনোনীত করল জাতীয় পার্টি
বিরোধী দল নিয়ে এবার কেন এত আলোচনা
গত দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত ১১ আসনে জয় পায়।
সাধারণ ধারণা হল, আসন সংখ্যায় সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল যাকে নেতা নির্বাচিত করবে, তিনিই বিরোধীদলীয় নেতার আসন পাবেন। তার দলই হবে সংসদের প্রধান বিরোধী দল।
গত দুটি নির্বাচনের মত এবারও দলীয়ভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়েছে জাতীয় পার্টি। সে কারণে তারা দাবি করছে, দ্বাদশ সংসদে প্রধান বিরোধী দল তারাই।
কিন্তু তাদের চেয়ে প্রায় ছয় গুণ আসনে দলনিরপেক্ষ প্রার্থীরা জিতে আসায় এবার আলোচনা ঘুরে যায়।
প্রশ্ন ওঠে, স্বতন্ত্ররা জোট করে প্রধান বিরোধী দল হতে পারবে কি না। আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও তখন বলেন, আইনত এটা ‘সম্ভব’।
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ‘বিরোধী দলীয় নেতা’ এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- ‘স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসঙ্ঘের নেতা।’
অবশেষে স্পিকার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও দলটির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলামকে সেই স্বীকৃতি দিলেন।
পাঁচ বছর আগে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সংসদ সদস্যদের শপথের এক সপ্তাহ পর বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা মনোনয়ন করে দিয়েছিলেন স্পিকার শিরীন শারমিন।
সেবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিবৃতিতে বলেছিলেন, তার দল নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ না দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা নেবে।
এর আগের দশম সংসদে জয়ের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে ছিল জাতীয় পার্টি।
একাদশ সংসদে ‘পদাধিকার বলে’ এরশাদ জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি দলের সভাপতি হন। পরে তিনি প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা এবং সেই সময় দলের কো চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে উপনেতা হিসেবে অনুমোদনের জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন করেন।
এরপর এরশাদের মৃত্যু হলে তার স্ত্রী রওশন এরশাদ একাদশ সংসদের বাকি সময়ে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। জিএম কাদের উপনেতাই থাকেন।
তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের পন্থিদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির নানা প্রশ্নে বিভক্তি দেখা দেয়।
সেই ধারাবাহিকতায় ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের অধিবেশন শুরুর দুদিন আগে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে আরেক নাটকীয়তার জন্ম দিলেন রওশন।
গত ৭ জানুয়ারির ওই নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে নতুন করে বিভক্তি দেখা দেয়। দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে মতবিরোধে গত সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন নিজে এবার নির্বাচনে অংশ নেননি। তার অনুসারীদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি জাতীয় পার্টি।
নির্বাচনের পর পার্টি থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ কয়েকজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়, যারা রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত।
এরপর গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ এনে ৬৭১ জন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
এই প্রেক্ষাপটে ‘পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে’ রোববার রওশন এরশাদের মতবিনিময় সভা ডাকা হয়। আর সেই মতবিনিময় হয় সাংবাদিকদের উপস্থিতিতেই। সেখান থেকে নিজেই দলের হাল ধরার ঘোষণা দেন।
এরপর জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, রওশনের দেওয়া অব্যাহতির আদেশ তারা আমলে নিচ্ছেন না।
“এবারই প্রথম নয়, এটা তৃতীয়বার। এর আগেও দুইবার তিনি এইরকম বাদ দিয়ে নিজেই চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। পরবর্তীতে প্রত্যাহার করেছেন উনার ঘোষণা দেওয়া ঠিক না।
“কাজেই উনার এই ঘোষণা আমি মহাসচিব হিসেবে নলেজে নিচ্ছি না। এটার কোনো ভিত্তি নাই। এটা অগঠনতান্ত্রিক, এ ধরনের কোনো ক্ষমতা উনার নাই। এই বিষয়টা আইনের ভাষায় যেটা বলে আমরা এটা আমলে নিচ্ছি না।”