"কাউকে কর্মসূচি পালনের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। কেউ কর্মসূচি পালন করলে আইনানুগ ব্যবস্থা যা নেওয়ার, তাই করা হবে,” বলেন ডিএমপি কমিশনার।
Published : 29 Jul 2023, 12:02 AM
ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির ঘোষণায় জনমনে উদ্বেগের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, শনিবার কোনো দলকেই তারা মাঠে নামার অনুমতি দেবে না।
ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক শুক্রবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের কাছে শনিবার কর্মসূচি পালনের জন্য দুটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আবেদন জমা পড়েছে। কিন্তু তারা কাউকেই সায় দেননি।
"কাউকে কর্মসূচি পালনের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। কেউ কর্মসূচি পালন করলে আইনানুগ ব্যবস্থা যা নেওয়ার, তাই করা হবে।”
সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিকালে নয়া পল্টনে মহাসেমাবেশ করে ঘোষণা দেয়, শনিবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা জোট ও দলগুলোও আলাদাভাবে একই কর্মসূচি দেয়।
এর পাল্টায় ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে শনিবার শান্তি সমাবেশের ডাক দেয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ। আটটি স্থানে শনিবার বেলা ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তাদের এ কর্মসূচি চলবে বলে জানানো হয়।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, দুই দলের কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ বাড়বে এবং সহিংসতার মত ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়টি বিবেচনা করে কাউকে অনুমোদন দেননি তারা।
“এ ধরনের কর্মসূচিতে ঢাকার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে, অনুমোদন না দেওয়ার পেছনে এ বিষয়টিও বিবেচনায় আনা হয়েছে।"
রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম বিভাগ থেকে পাঠানো এক ক্ষুদে বার্তায় ডিএমপি কমিশনারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “আগামীকাল শনিবার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন রাজধানীর ঢাকার সকল প্রবেশমুখে সকাল ১১টা হতে বিকাল ৪টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। উক্ত রাজনৈতিক দল সমূহ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নিকট হতে এই অবস্থান কর্মসূচি পালনের জন্য কোনো অনুমতি গ্রহণ করেনি।
“আইনশৃঙ্খলা অবনতির গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও জনদুর্ভোগের বিষয় বিবেচনায় আগামিকালের সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থান কমসূচি পালনে ডিএমপির পক্ষ থেকে অনুমতি দেয়া হল না।”
দুই পক্ষ কী বলছে?
ঢাকা মহানগর পুলিশ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও বিএনপি কর্মসূচিতে অনড় থাকার ইংগিত দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। আমাদের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে ডিএমপি কমিশনারকেও চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছে। আমরা আমাদের ঘোষিত এই কর্মসূচি করব। এটা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি।”
আর দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “আমরা শনিবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকার প্রবেশ পথে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান কর্মসূচি সফল করার জন্য ঢাকাবাসীসহ বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সকল নেতাকর্মীকে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।”
পুলিশ কমিশনারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান নিখিল রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমরা অনুমতি চেয়েছি, অনুমতি দেওয়া হয়নি এটা জানি না। তবে আমাদের প্রস্তুতি আছে, যদি অনুমতি না দেয় তাহলে আমরা নামব না।"
কোথায় কার কর্মসূচি
বিএনপি: গাবতলী, উত্তরা, নয়াবাজার ইউসুফ মার্কেট, শনির আখড়া এবং মুক্তি সরণি
গণতন্ত্র মঞ্চ: মিরপুর মাজার রোডে
১২ দলীয় জোট: চট্টগ্রাম রোড দনিয়া কলেজ পার হয়ে
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট: চট্টগ্রাম রোড সাইনবোর্ড পার হবার আগে
গণফোরাম ও পিপলস পার্টি: মতিঝিল নটরডেম কলেজের উল্টো দিকে গণফোরাম চত্বরে
এলডিপি: উত্তর আজমপুর বাস স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়, গাবতলী টেকনিক্যাল মোড় এবং যাত্রাবাড়ী মোড়ে
এনডিএম: চট্টগ্রাম রোড সাইনবোর্ড সংলগ্ন এলাকায়
যুবলীগের শান্তি সমাবেশ: আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী, গাবতলী, আমিনবাজার, বাবু বাজার, সাইনবোর্ড, কাঁচপুর, যাত্রাবাড়ীতে।
বাড়ছে উত্তেজনা
গত ১২ জুলাই ঢাকায় একই দিনে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ।
নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশ থেকে সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরসহ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি রয়েছে এই এক দফার মধ্যে।
অন্যদিকে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে আওয়ামী লীগের সমাবেশ থেকেও আসে পাল্টা এক দফার ঘোষণা। বলা হয়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে।
এক দফা দাবিতে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই সারাদেশে মহানগর ও জেলায় পদযাত্রা করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এ পাল্টায় ওই দুই দিন ঢাকাসহ সারা দেশে শান্তি শোভাযাত্রা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এরপর বিএনপি বৃহস্পতিবার ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকলে আওয়ামী লীগের তিন সংগঠনও একই দিনে শান্তি সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কর্মদিবসে রাজপথে এমন কর্মসূচিতে পুলিশ সায় না দেওয়ায় দুই পক্ষের সমাবেশ এক দিন পিছিয়ে শুক্রবার আসে।
একইরকম ২৩ শর্তে বিএনপিকে নয়া পল্টন এবং আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছ্বাসেবকলীগ ও ছাত্রলীগকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেইটে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়।
শুক্রবার সকালে এসএসসির ফল প্রকাশ হলেও দুই দলের কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগে স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের আনন্দ সমাবেশে কিছুটা ভাটা পড়ে। সকাল থেকেই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে পুলিশের তল্লাশি চলে। রাস্তায় যানবাহন দেখা যায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
বিএনপির সমাবেশ এলাকায় ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে এবারও। তবে বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, নিয়ন্ত্রণমূলক কোনো পদক্ষেপ তারা নেয়নি, বেশি লোকসমাগম হওয়ায় নেটওয়ার্কে ধীর গতি হতে পারে।
দুপুরে সমাবেশ শুরুর পর দুই পক্ষের কর্মীদেরই কয়েক দফা বৃষ্টিতে কাকভেজা হতে হয়। বিকাল ৫টার মধ্যে সমাবেশ শেষ করার কথা থাকলেও দুই পক্ষের কর্মসূচিই প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়ায়।
নয়া পল্টনের মহাসমাবেশ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এই সরকার বেআইনি, অসাংবিধানিক, অবৈধ এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। দফা এক, দাবি এক, পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে।”
একই সময়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেইটের শান্তি সমাবেশ থেকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, “রাস্তা বন্ধ করবেন, আপনাদের চলার রাস্তা বন্ধ করে দেব। চোখ রাঙাবেন না, দেশি-বিদেশি যারাই চোখ রাঙাবেন তাদের বলে দিচ্ছি, আমাদের শিকড় অনেক গভীরে। চোখ রাঙিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবেন না।”
বিএনপির সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, তাদের শনিবারের অবস্থান কর্মসূচি হবে ‘শান্তিপূর্ণ’; আর এটা তাদের ‘সাংবিধানিক অধিকার’।
সরকার ও প্রশাসনের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা আশা করব, যে প্রশাসন, তারা এই কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে।
“আমরা এটাও আশা করব, কালকে যে ছুটির দিন আছে এবং পবিত্র আশুরা আজকে রাত থেকে শুরু হবে… আজকে রাতেই শেষ হয়ে যাবে। সেই কারণে সকল দলকে একসঙ্গে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে আমরা আমাদের এই কর্মসূচিটা পালন করব… সেটাই হচ্ছে আমাদের আগামীকালের ঘোষণা। প্রশাসন ও সরকার যাতে সহযোগিতা করে এই আশা আমি করছি।”
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তিন সংগঠনের সমাবেশে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ অতন্দ্র প্রহরীর মত পাহারা দেবে।”
আওয়ামী লীগ সংঘাত চায় না মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির উদ্দেশে বলেন, “কোথায় দাঁড়াবেন, আমরা ছেড়ে দেব। আমরা সংঘাত চাই না, আমরা শান্তির জন্য এই সমাবেশ করছি। যত লাফালাফি তাফালিং করেন ফখরুল সাহেব, এই তারেক জিয়ার লাফালাফিতে কাজ হবে না। যতই তাফালিং করুন ক্ষমতার ময়ুর সিংহাসন বহুদূরে। রাজনীতির মাঠে আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে হারাতে পারবেন না। আন্দোলনে আওয়ামী লীগ চ্যাম্পিয়ন। আগুন নিয়ে আসবেন, আগুনে হাত পুড়িয়ে দেব, ভাঙচুর করতে আসলে হাত ভেঙে দেব।”
অল্প দূরত্বে দুই বড় দলের বড় জমায়েত শেষ পর্যন্ত বড় কোনো সংঘাতের দিকে না গেলেও অঘটন ঠিকই ঘটেছে।
শান্তি সমাবেশ শেষ গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীদের সংঘর্ষের মধ্যে ছুরিকাঘাতে একজনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন আরও চারজন।