মির্জা ফখরুল বলেন, “দফা এক, দাবি এক, পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে।”
Published : 28 Jul 2023, 07:08 PM
ঢাকায় মহাসমাবেশ করে সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচিতে রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি।
শনিবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে বিএনপির এই অবস্থান কর্মসূচি চলবে।
শুক্রবার বিকালে ঢাকার নয়া পল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, “এই সরকার বেআইনি, অসাংবিধানিক, অবৈধ এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন হতে পারে না। দফা এক, দাবি এক, পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে।”
যে চার জায়গায় বিএনপির অবস্থান
নয়াবাজারে বিএনপি অফিসের সামনে
গাবতলী এস এ খালেক বাসস্ট্যান্ডের সামনে
যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে দনিয়া কলেজ সংলগ্ন মাঠে
উত্তরা বিএনএস সেন্টারের উল্টো দিকের রাস্তায়
সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের ক্রন্তিলগ্নে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ শিকার করতে হয় তরুণদের।
“আমাদের ছয়শ নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ৪০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। গত দুই দিনে মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসা কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
“গ্রেপ্তার করে কী আমাদের থামানো যাবে? আমরা পুলিশকে, প্রশাসনকে বলতে চাই, আপনারা এই ভয়াবহ একটা দলীয় সরকারের বেআইনি আদেশ-নির্দেশে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না।”
এই আন্দোলনের লক্ষ্য তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “সমস্ত দলগুলো, যারা আন্দোলনে থাকবে, তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করব। আজকে আমরা শুধু একা নই। বাইরের দেশগুলো, আন্তর্জাতিক বিশ্ব তারাও বলছে তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়।
“আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বেআইনি গ্রেপ্তার বন্ধ করুন, যারা কারাগারে আছেন তাদের ছেড়ে দিন। খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে মুক্তি দিন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুন। ভালো চাইলে আমাদের এক দফা দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করুন।“
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের সভাপতিত্বে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার এই সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারাও বক্তৃতা দেন।
পাশাপাশি লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি অডিও বক্তব্য প্রচার করা হয়, যদিও আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকায় তার বক্তব্য বিবৃতি প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মির্জা ফখরুল মহাসমাবেশের ‘চমক’ হিসেবে তারেক রহমান বক্তব্য দেবেন বলে ঘোষণা করেন। সেই বক্তব্যের পর শনিবার ঢাকা মহানগরের সকল প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে সমাবেশ শেষ করেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যে যুগপৎ আন্দোলন আন্দোলনে রয়েছে, তার অংশ হিসেবে এই কর্মসূচি পালন করা হবে।
“আমাদের এই অবস্থান কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ হবে। এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার।”
সরকার ও প্রশাসনের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা আশা করব, যে প্রশাসন, তারা এই কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে।
“আমরা এটাও আশা করব, কালকে যে ছুটির দিন আছে এবং পবিত্র আশুরা আজকে রাত থেকে শুরু হবে… আজকে রাতেই শেষ হয়ে যাবে। সেই কারণে সকল দলকে একসঙ্গে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে আমরা আমাদের এই কর্মসূচিটা পালন করব… সেটাই হচ্ছে আমাদের আগামীকালের ঘোষণা। প্রশাসন ও সরকার যাতে সহযোগিতা করে এই আশা আমি করছি।”
সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ‘এক দফা’ দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা জোট ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঢাকায় আলাদা আলাদাভাবে সমাবেশ করে শুক্রবার।
গত ১২ জুলাই শুরু হওয়া এক দফার আন্দোলনের এটি দ্বিতীয় কর্মসূচি ছিল। এর আগে ১৮ ও ১৯ জুলাই সারাদেশে মহানগর ও জেলায় পদযাত্রা করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
‘দেশের ভালো চাইলে পদত্যাগ করুন’
মহাসমাবেশে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, “সরকারকে এখনো বলছি, যদি ভালো চান, দেশের মঙ্গল চান, তাহলে এখনো সময় আছে আমাদের যে এক দফা দাবি তা মেনে নিয়ে পদত্যাগ করুন।”
এরপর সমবেতদের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন করেন– “তা নাহলে ফয়সালা কোথায় হবে?”
নেতাকর্মীরা এ সময় সমস্বরে স্লোগান তোলেন– ‘রাজপথে রাজপথে’।
মির্জা ফখরুল বলেন, “প্রশাসনকে বলতে চাই, আপনারা এই ভয়াবহ একটা দলীয় সরকারের বেআইনি আদেশ-নির্দেশে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না। আমরা জানি যে, আপনারা সবাই এদেশের মঙ্গল চান, আপনারা এই দেশের কল্যাণ চান। আপনারা শপথ নিয়েছেন যে, এদেশের স্বার্থে সংবিধান অনুযায়ী কাজ করবেন।
“ আমরাও আপনাদের কাছে সেটাও চাই। আপনারা জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই সমাবেশ থেকে গ্রেপ্তার বন্ধ করুন, বেআইনি গ্রেপ্তার বন্ধ করুন, হয়রানি বন্ধ করুন এবং যারা কারাগারে আছে তাদেরকে ছেড়ে দিন।”
এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ও তারেক রহমানসহ নেতা-কর্মীদের নামে থাকা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।
নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বেলা ২টায় শুরু হয় মহাসমাবেশ, শেষ হয় সাড়ে ৬টায়।
কার্যালয়ের সামনে নয়টি ট্রাককে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে উত্তরমুখী অস্থায়ী মঞ্চ। ব্যানারে একদিকে খালেদা জিয়া ও অন্যদিকে জিয়াউর রহমান ও তারেক রহমানের প্রতিকৃতি রেখে লেখা হয়– ‘যুগপৎ ধারার বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের ১ দফার মহাসমাবেশ’।
মহাসমাবেশের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় বেলা ২টায় জুমার নামাজের পরে। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের শিল্পীরা গণসংগীত ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন।
সকাল থেকেই নেতা-কর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন। সাদা, নীল, লাল, সবুজ ও হলুদ টুপি মাথায় হাজারো নেতা-কর্মী এ সময় সরকারবিরোধী স্লোগান দেন।
ভিড় বাড়তে থাকায় সকালেই নয়া পল্টনের সড়কে যান চালাচল পুলিশ বন্ধ করে দেয়।
সমাবেশ শুরুর পর দুই দফা বৃষ্টিতে ভিজতে হয় নেতা-কর্মীদের। অবশ্য পরে আবার রোদ ওঠে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে এখানে (নয়া পল্টন এলাকায়) ইন্টারনেট নাই। বিএনপির যখন সমাবেশ হয় তখন ইন্টারনেট থাকে না। যারা এই ইন্টারনেট বন্ধের পেছনে কাজ করছেন তারা ভোট চোরদের দালাল হিসেবে কাজ করছেন।”
“আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই ভোট চোরের দালালরা সাবধান হয়ে যান। আপনারা ভোট চোরের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছেন, আপনারা ভোট চুরির প্রকল্পে কাজ করছেন। সাবধান, সাবধান।”
মহাসমাবেশের সভাপতি, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “পাখিরও বাসা আছে, পোকামাকড়েরও থাকার জায়গায় আছে। কিন্তু এই মহাসমাবেশে আসা আপনারা কোথায় খাওয়া দাওয়া করেছেন আমি জানি না। কোথায় ছিলেন কেমন ছিলেন সেটাও দেখতে পাইনি। তবে আপনারা সাহসের পরিচয় দিয়েছেন এতো নিপীড়ন-নির্যাতন-গ্রেপ্তারের পরও আপনারা এই মহাসমাবেশে এসেছেন এজন্য আপনাদের সাধুবাদ জানাই।”
নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে রাজপথে আন্দোলনে থাকার আহ্বান জানান মির্জা আব্বাস।
মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ও দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামের সঞ্চালনায় মহাসমাবেশে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, শাহজাহান ওমর, বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান, জয়নুল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মিজানুর রহমান মিনু, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, জয়নুল আবদিন ফারুক, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, হারুনুর রশীদ, আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবে রহমান শামীম, আসাদুল হাবিব দুলু, সাখাওয়াত হোসেন জীবন, মোস্তাক মিয়া, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিলকিস জাহান শিরিন, শামা ওবায়েদ, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া যুব দলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানি, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসেইন, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, মতস্যজীবী দলের রফিকুল ইসলাম মাহতাব, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ, ছাত্র দলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, মহানগর উত্তরের আমিনুল হক, দক্ষিনের তানভীর আহমেদ রবিনসহ অঙ্গসংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন।