এক যুগ আগে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ছয়জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছে হাই কোর্ট।
Published : 15 Jun 2016, 01:36 PM
এ মামলায় ২০০৫ সালে নিম্ন আদালতে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া ২২ আসামিদের মধ্যে সাতজনের সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিদের মধ্যে একজনের দণ্ড বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। যাবজ্জীবনের আরেক আসামি আপিল না করায় তার ক্ষেত্রেও একই শাস্তি প্রযোজ্য থাকছে।
দ্রুত বিচার আদালতে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল- এমন ১১ জন হাই কোর্টে খালাস পেয়েছেন।
আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, জেল আপিল ও আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এই রায় দেয়।
২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়। তার সঙ্গে খুন হন ওমর ফারুক রতন নামে আরেকজন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, “বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অতীতে খুবই কম সংঘটিত হয়েছে। রাজনীতিতে দুবৃত্তায়ন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ স্কুলে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহ থেকে সম্যক উপলব্ধি করা যায়।”
যে স্থানে ও যেভাবে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, তাকে ‘ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বা মাসকিলিং’ হিসেবে বর্ণনা করেন বিচারক।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ না ঘটলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না; গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে।
রায়ে পুরোপুরি ‘সন্তুষ্ট নন’ জানিয়ে আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল বলেছেন, যাদের দণ্ড কমানো বা খালাস দেওয়া হয়েছে, তাদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন তারা।
আর আসামি নুরুল ইসলাম সরকার ‘নির্দোষ’ দাবি করে তার ভাই বিএনপির সাবেক সাংসদ হাসান উদ্দিন সরকার বলেছেন, পরে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী এম মাসুদ রানা জানিয়েছেন, হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন।
হাই কোর্টের রায়
>> নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড হওয়া ২২ আসামির মধ্যে ছয় জনের সর্বোচ্চ সাজা বহাল, সাতজনের সাজা কমে যাবজ্জীবন ও সাতজন খালাস। দুই আসামির মৃত্যু হওয়ায় তাদের মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
>> নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ছয় আসামির মধ্যে একজনের দণ্ড বহাল, চারজন খালাস। বাকি একজন আপিল না করায় তার দণ্ডও বহাল রয়েছে।
>> হাই কোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা একজন, যাবজ্জীবনের পাঁচজন এবং খালাস পাওয়া ১১ আসামির মধ্যে তিনজন পলাতক রয়েছেন। খালাস পাওয়া পলাতক ওই তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল নিম্ন আদালত।
আদালত প্রাঙ্গণ ও রায়
আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন টঙ্গী শিল্পাঞ্চলের একজন শ্রমিক নেতা হিসেবে। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি। পরে তার আসনের সাংসদ হন তার ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল।
রায় ঘিরে গাজীপুরের আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের শত শত-সমর্থক বুধবার সকাল থেকে আদালত চত্বরে ভিড় জমাতে থাকেন। জোরদার করা হয় আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা।
বেলা ১টায় এজলাসে আসেন বিচারকরা। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, বিচারপ্রার্থী ও সকলের বোঝার সুবিধার্থে রায়টি বাংলায় দেওয়া হচ্ছে।
“রায়টি লিখেছেন সহকর্মী বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। তার দেওয়া রায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে নিজস্ব কিছু বক্তব্য ও পর্যবেক্ষণ প্রদান করছি।”
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ওই হত্যাকাণ্ডকে ‘একটি জঘন্য ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “নিঃসন্দেহে বলা যায়, নুরুল ইসলাম সরকার ও নুরুল ইসলাম দিপু গং এই মাস কিলিংয়ের জন্য সরাসরি দায়ী।... আহসান উল্লাহ মাস্টারের মত একজন আদর্শবান সংসদ সদস্য বেঁচে থাকলে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে তিনি আরও অনেক ভাল কাজ করতে পারতেন, যা থেকে জাতি উপকৃত হত। সাজাপ্রাপ্ত অভিযুক্তরা আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতিকে সেই সুযোগপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে।
“তারা হত্যা করেছে একটি আদর্শকে। আজকের সমাজে আহসান উল্লাহ মাস্টারের মত আদর্শবান রাজনৈতিক নেতার বড়ই অভাব।”
এরপর ডেথ রেফারেন্স আংশিক মঞ্জুর করে রায়ের কার্যকরি অংশ ঘোষণা করেন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। আদালত কক্ষে তখন পিন-পতন নীরবতা।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, বিচারিক আদালতের নথি ও সাক্ষীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে হাই কোর্ট রায়ে বলেছে, ২০০৪ সালের ওই হত্যাকাণ্ডের মূলে ছিল মাদকের কারবার নিয়ে বিএনপির নুরুল ইসলাম সরকার এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহফুজুর রহমান মহলের মধ্যে বিরোধ।
“ঘটনা থেকে দেখা যায়, নুরুল ইসলাম সরকারের সঙ্গে তখনকার সময়ের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন এবং আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহফুজুর রহমান মহলের সঙ্গে যতটুকু না ছিল রাজনৈতিক বৈরিতা তার চেয়েও বেশি ছিল অর্থনৈতিক সংঘাত। নুরুল ইসলাম সরকার স্থায়ীভাবে একজন ব্যবসায়ী, মাহফুজুর রহমান মহলও একজন ব্যবসায়ী।
“উভয়ের মধ্যে স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের একটি প্রতিযোগিতা চলছিল। মহলের রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও যেহেতু তিনি নুরুল ইসলাম সরকারের বিচ্ছিন্ন মাদক ব্যবসায় বাধা সৃষ্টি করেছিলেন, সেহেতু নুরুল ইসলাম সরকার ও সঙ্গীগণ মহলকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।”
সেই পরিকল্পনার কথা আসামি মাহবুবুর রহমানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসেছে এবং দুজন সাক্ষী তা সমর্থন করেছেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
টঙ্গীর ওই জনসভায় হামলার ঘটনায় মহলসহ আরও অনেকে আহত হন। খুন হন আহসান উল্লাহ মাস্টার ও ওমর ফারুক রতন।
“ঘটনার দিন এই দুইজনকে নুরুল ইসলাম সরকারের গাড়িতে করে বয়ে নিয়ে আসা এবং সেখান থেকে তার দ্বারা উৎসাহিত হয়ে সভাস্থলে গিয়ে দিপু ও শিপু কর্তৃক আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি করার ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে মাহফুজুর রহমান মহলকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি তারা আসাহান উল্লাহ মাস্টার এমপিকেও হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই।”
জননেতা থাকাকালে আসাহান উল্লাহ মাস্টার গাজীপুরে মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।
সেখানে বলা হয়, এমপি, পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ শত শত নেতাকর্মী উপস্থিত থাকবেন জেনেও আসামিরা হামলার জন্য ওই স্থানটি বেছে নিয়েছিল। বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলি হলে প্রচুর লোক মারা যেতে পারে জানার পরও তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা কাজ করেনি। প্রকাশ্যে দিনের আলোয় ওইরকম একটি হামলার জন্য কোনোরকম মুখোশও তারা ব্যবহার করেনি।
“তারা এতোটাই বেপরোয়া ছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে তাদের চেহারা অনাবৃত থাকার কারণে কেউ যদি তাদেরকে চিনেও ফেলে, তথাপি তাদের কিছু হবে না। তাদের এ ধরনের ভাবনার কারণ হল তাদের পেছনে এমন একটি শক্তি রয়েছে যে বা যারা তাদের সম্ভাব্য সব ঝামলা থেকে রক্ষা করার শক্তি রাখে।”
যার জন্য যেমন রায়
মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে ৬ জনের নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু (পলাতক), মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু, হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ, সোহাগ ওরফে সরু। |
৭ জনের সাজা কমে যাবজ্জীবন মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু (পলাতক), আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু (পলাতক), রতন মিয়া ওরফে বড় মিয়া, জাহাঙ্গীর (পলাতক), মশিউর রহমান ওরফে মশু (পলাতক), আবু সালাম ওরফে সালাম। |
যাবজ্জীবন বহাল নুরুল আমিন |
বিবেচিত হয়নি পলাতক আসামি অহিদুল ইসলাম টিপু আপিল করেননি। তার যাবজ্জীবন সাজাই বহাল। |
নিষ্পত্তি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছোট রতন ও আল আমিন মারা যাওয়ায় তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিয়েছে হাই কোর্ট। |
খালাস আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, ফয়সাল (পলাতক), লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির (পলাতক), খোকন (পলাতক), দুলাল মিয়া, রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর (পিতা মেহের আলী) ও মনির। |
অভিযোগপত্রে থাকা দুই আসামি কবির হোসেন ও আবু হায়দার ওরফে মিরপুরইয়া বাবু নিম্ন আদালত থেকেই খালাস পান।
হত্যাকাণ্ডের পরদিন নিহতের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
তদন্ত শেষে এই মামলায় ওই বছরের ১০ জুলাই ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। একই বছরের ২৮ অক্টোবর ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ৩৪ জন এবং আসামিপক্ষে দুজন সাক্ষ্য দেন।
এ মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন।
ওই রায়ে বিএনপি নেতা নূরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান দুজন।
নিম্ন আদালতের রায়ের পর ২২ আসামির ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) শুনানির জন্য ২০০৫ সালে হাই কোর্টে আসে। তাদের মধ্যে ১৪ জন দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আসামি শহীদুল ইসলাম শিপু ও লোকমান হোসেন হাই কোর্টে পৃথক ফৌজদারি বিবিধ আবেদন করেন, শুধু জেল আপিল করেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কানা হাফিজ।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া পলাতক এক আসামি আত্মসমর্পণ না করায় আপিলের সুযোগ পাননি।
প্রধান বিচারপতি বিষয়গুলো শুনানির বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে পাঠালে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি শুনানি শুরু হয়। ৩৪তম দিনে ৮ জুন শুনানি শেষে আদালত ১৫ জুন রায় ঘোষণার জন্য দিন রাখে।
বুধবার রায়ের মধ্য দিয়ে এক যুগ আগে ঘটে যাওয়া নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডে নিম্ন আদালতের রায়ের ১১ বছর পর বিচারের পরিসমাপ্তি হয় হাই কোর্টে।
রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রোনা নাহরিন, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মনজু নাজনীন উপস্থিত ছিলন।
বাদীপক্ষে আইনজীবী কাজী সাজাওয়ার হোসেন ও আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ আহসান রাসেলসহ নিহতদের স্বজন, কর্মী ও সমর্থকরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান, এম মাসুদ রানা, নাসরিন খন্দকার এবং আসামিদের কারও কারও স্বজন।