সবাইকে ভোটে আনার দায়িত্ব সরকারের নয়, ইসির: তথ্যমন্ত্রী

“দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখছি, সংসদ ক্রমাগতভাবে আমাদের পার্লামেন্টের মান ক্রমাগতভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে”, বলেন রাশেদ মান মেনন।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2023, 10:17 AM
Updated : 8 April 2023, 10:17 AM

ভোট বর্জনে বিএনপির আগাম ঘোষণার প্রতি ইঙ্গিত করে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, কাউকে ভোটে আনার দায়িত্ব সরকার বা সরকারি দলের নয়। এটা নির্বাচন কমিশনের কাজ।

সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে শনিবার সংসদে আনা সাধারণ প্রস্তাবের উপর আলোচনায় একথা বলেন তিনি।

মন্ত্রী বলেন, “আগামী সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যে নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। গণতন্ত্রের পথ চলা নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য, সংসদীয় যাত্রা নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য কেউ নির্বাচনে আসুক কিংবা না আসুক ‍নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে হবে, নির্বাচন যথাসময়ে হবে।”

নির্বাচনকালীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে না নেওয়ায় ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে ভোট ঠেকাতে আন্দোলনে গিয়েছিল বিএনপি। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা অংশ নেয় নির্বাচিত সরকারের অধীনেই।

এবার আবার তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে ফিরে গিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে দলটি। বলছে, দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।

দশম সংসদ নির্বাচনের স্মৃতিচারণ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “২০১৪ সালের ভোট বানচালের জন্য ৫০০ ভোটকেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়েছিল। দুজন নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ কয়েকডজন মানুষকে হত্যা করেছিল। কিন্তু নির্বাচন হয়েছে, সংসদের যাত্রা অব্যাহত থেকেছে।গণতন্ত্রের পথ চলা অব্যাহত রয়েছে।

“আজকেও সে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। কদিন আগে বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পদত্যাগ করলেন, এটি সংসদের পথ চলাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যে।”

সব দলের অংশগ্রহণে ভোটের বিষয়ে নানা মহল থেকে যে কথাবার্তা হচ্ছে, সে বিষয়ে হাছান বলেন, “সবাইকে দাওয়াত করে নির্বাচনে আনা- এটি সরকারি দলের দায়িত্ব নয়। একটি পক্ষ নির্বাচন কমিশন, সরকারি দলও একটি পক্ষ, সব বিরোধী দলও আরেকটি পক্ষ। সেখানে নির্বাচনে আনা না আনার, নির্বাচনে কেউ আসবে কি আসবে না- সে দায়িত্ব পালন করতে পারে নির্বাচন কমিশন।”

কমিশনের দায়িত্ব কীভাবে, সেটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যখন তফসিল ঘোষণা করা হয় তখন সরকারের হাতে ক্ষমতা থাকে না। তখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন আয়োজন করবে এবং সব দল অংশ নেবে। কাউকে হাতে পায়ে ধরে, দাওয়াত করে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব সরকারের নয়, সরকারি দলের নয়।”

‘নির্বাচনে না এলে কারও কিছু বলার নেই’

তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সহমত প্রকাশ করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, “সব দলকে নির্বাচনে আনা সরকারের দায়িত্ব নয়। এটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।

“নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে, আস্থা তৈরি করতে হবে। সে সহায়তা সরকারকে দিতে হবে। সেটাই সরকারের দায়িত্ব। পরিবেশ তৈরির পরও কেউ নির্বাচনে না এলে কারও কিছু বলার নেই।”

‘সংসদের মান ক্রমাগত ক্ষুন্ন হচ্ছে’

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমরা এমন একটি সংসদ তৈরি করবো যা অন্যের জন্য শিক্ষার বিষয় হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখছি- সংসদ ক্রমাগতভাবে আমাদের পার্লামেন্টের মান ক্রমাগতভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

“আমাদের সংসদের চরিত্র ক্রমাগত পাল্টে যাচ্ছে। রাজনীতির বাণিজ্যায়ন, নির্বাচনের বাণিজ্যায়নের ফলে সংসদের নতুন চেহারা দাঁড়িয়েছে।

“সংসদে আজকে ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক বেশি।…আজকে আমাদের প্রয়োজনের সংসদের বিষয়ে সংস্কার করা, সংবিধান পর্যালোচনা প্রয়োজন।”

বিএনপি ‘পাকিস্তানের প্রক্সি প্লেয়ার’

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, “বিএনপি পচাঁত্তরের পর যেসব অপরাধ করেছে, এখনও তার পক্ষে সাফাই গাইছে। বিএনপি আসলে মুখে বাংলাদেশ অন্তরে পাকিস্তান বলে জপ করছে।

“বিএনপি আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে পাকিস্তানের প্রক্সি প্লেয়ার। বিএনপি সংবিধান খেয়ে ফেলতে চায়। রাজাকারদের রাজনীতির মধ্যে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়। তারা সাংবিধানিক ধারা বানচাল করতে চায়। অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।”

‘বিএনপি থাকার দরকার নেই’

সরকারি দলের সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ জানান, ‘বিএনপি না থাকুক’, এটাই তিনি কামনা করেন।

তিনি বলেন, “বিএনপি ক্ষমতায় নেই বলে দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিএনপি সেটার জন্য দায়ী থাকবে। তারা খুনির দল, ষড়যন্ত্রকারী। আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশ চিন্তাই করা যায় না।”

‘বিএনপি যা বোঝায়, তা নয়’

‘বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কথাটা আপেক্ষিক’- রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কির এমন উদ্ধৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলেন, “এই কথার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে বিএনপি যা বোঝায়, তা কিন্তু নয়।

“আমরা মনে করি আমাদের দেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষার হার, অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে অবস্থা, তার উপর ভিত্তি করে বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়ার কথা।”

তিনি বলেন, “কোনো দেশের সমাজ কতটা স্বাধীনতা ভোগ করবে তা নির্ভর করবে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। যে দেশ যতটা শিক্ষিত নাগরিক অধিকার অত্যন্ত সচেতন, অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত সেখানে বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ততটা উন্নত।

“শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা এবং আর্থিক ব্যবস্থায় অনগ্রসর দেশে ততটা বাক স্বাধীনতা আশা করা অন্যায়। এই স্বাধীনতা অনগ্রসর দেশে দেওয়া হলে তা হবে শিশুর হাতে খুন্তি তুলে দেওয়ার মতো।”

‘তখন স্বাধীনতার চেতনা কোথায় ছিল?’

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে দাবি করে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য তানভীর শাকিল জয় বলেন, “আজকে আমাদের মহান স্বাধীনতা, স্বাধীনতাযুদ্ধকে অপমান করা হয়। স্বাধীনতা দিবসকে অপমান করে বিকৃতভাবে চাইল্ড এক্সপ্লোটেশনের মাধ্যমে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়।

“আমি সে সকল সুশীল বাবুদের এবং তাদের পত্রিকার কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তখন স্বাধীনতার চেতনা কোথায় ছিল? যখন ২১ অগাস্টে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, তখন স্বাধীনতা কোথায় ছিল? যখন বাংলাদেশে সারের জন্য কৃষকদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, যখন বিদ্যুতের জন্য সাধারণ মানুষকে গুলি করা হয়েছিল তখন স্বাধীনতা কোথায় ছিল? তখন তো আপনাদের বোধোদয় হয় নাই। তখন তো আপনারা স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন নাই। এখন আপনারা স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন।”

‘পরিবর্তনের সংসদ দরকার’

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “সংসদের ধারণাই হচ্ছে যারা দেশ চালাবে তাদের ভুলগুলো বিরোধী দল ধরিয়ে দেবে, পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে।”

নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই সংসদ কাঠামোগতভাবে সরকারকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করতে পারে না। এর কারণ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। প্রশ্নোত্তর পর্ব আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সংসদীয় কমিটিগুলো নিয়মিত বসছে না। কমিটির বেশিরভাগ সভাপতি সরকারি দলের। মন্ত্রী, সভাপতি একই দলের। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মত সংসদীয় কমিটিগুলো কাজ করতে পারছে না।

“বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বাজেটের ১ শতাংশ পরিবর্তন করা যায় না। এখন সময় এসেছে সেই সংসদ তৈরি করার যেটা পরিবর্তন আনতে পারবে, আইনের পরিবর্তন আনতে পারবে, যে সংসদ বাজেটে পরিবর্তন আনতে পারবে। যে সংসদ বিরোধী দলের ‘ভয়েজ’ সংখ্যা দিয়ে বিচার করবে না, যৌক্তিতায় বিচার করা হবে।”

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “এর কারণে আমরা মনে করি সারা বাংলাদেশের বাক স্বাধীনতা আছে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় সংসদের এমপিদের বাক স্বাধীনতা নাই। সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী, বাজেটের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা কিছু বাদ দিলে, বাকি সব বিষয়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণ ওপেন করে দেওয়া উচিত।”

আলোচনায় অংশ নেন দীপু মনি, নসরুল হামিদ, ফরহাদ হোসেন, আবদুস শহীদ, মোসলেম উদ্দিম, রাজউদ্দিন রাজু, ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক, সৈয়দা জাকিয়া নূর, সিমিন হোসেন রিমি, নাহিম রাজ্জামক, হাবিবা রহমান খান, সাইফুজ্জামান শিখরও।